“দাদা শুনলাম নাকি ভানু বাবু বলে একজন গান বাজনা করতে আসছেন দল বল নিয়ে?”
“হ্যাঁ দাদা, ঠিকই শুনেছেন। আর আমিও অপেক্ষা করছি সেই অনুষ্ঠানটির জন্য। ”
ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথোপকথন হচ্ছিল সাউথ সিটি রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স এর দুই অবাঙালি বাসিন্দার মধ্যে ষষ্ঠীর সন্ধ্যে বেলা দূর্গা পুজো উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলাকালীন। দর্শকের আসনে ছিলাম আমিও। খুব মজা লাগল কথোপকথন শুনে। কারণ, এই ভানুবাবুর সাথে আপামর বাঙালির পরিচয় আছে কিন্তু উৎসাহী ওই দুই ভদ্রলোকের কাছে রহস্যটা আর ভাঙলাম না, ভাবলাম অনুষ্ঠান শেষে না হয় জানা যাবে কেমন লাগল ভানু বাবুর দলবলকে ।
এবার একটু খুলে বলি। এই ভানুবাবু হলেন স্বয়ং ভানুসিংহ মহাশয়। আর তাঁকে সঙ্গে নিয়ে এলেন এ শহরের প্রখ্যাত ভারতনাট্যম শিল্পী মধুবনী চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর দল জাহ্নবী এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মনোজ মুরলি নায়ার ও তাঁর দল ডাকঘর। ভানুসিংহের পদাবলী ও কবি জয়দেবের গীত গোবিন্দ থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ ছিল সেই সন্ধ্যের জাহ্নবী ও ডাকঘরের যৌথ নিবেদন “ভানুসিংহ বন্দিছে ” ।
.শ্রীমতি চট্টোপাধ্যায় ও শ্রী নায়ার ছাড়া সেই সন্ধ্যায় অংশগ্রহনে ছিলেন জাহ্নবী থেকে অনন্যা ,ঝিলিক, রিয়া ও মিতালি এবং ডাকঘর থেকে অরুণিমা , অনুশিখা , চিত্রা ,মধুপর্ণা , মোহর, শ্রীতমা ও স্মিতা।
অনুষ্ঠান শুরু হয় শ্রী নায়ার ও তাঁর ছাত্রীদের কন্ঠে কবি জয়দেবের শ্রীকৃষ্ণ নামকীর্তনের সাথে। সৃষ্টি হয় এক অপূর্ব ভক্তি ও প্রেম এর সমন্বয় এবং মঞ্চ জুড়ে তখন এক মোহময় পরিবেশ। এরপর পদাবলীর একেকটি গানের সাথে একক ও সমবেত নৃত্য পরিবেশনায় শ্রীমতি চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর দল কবিগুরুর পদাবলী কে জীবন্ত করে তোলেন।
শ্রীমতি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে আমার নৃত্যশিখ্যা আরম্ভ অনেক ছোট বয়স থেকে। নাচের সাথে সাথে রবীন্দ্র অনুরাগ তাঁর কাছ থেকে আমার পরম পাওয়া। বেশ কিছু বছর কর্মসূত্রে থাকতে হয়েছে প্রবাসে। গুরুর সাথে শিষ্যের এক মঞ্চে অনুষ্ঠান করার পরম সৌভাগ্য এই মুহূর্তে না হলেও দর্শকের আসনে বসে খুব কাছ থেকে এই বিশিষ্ট মানুষটির হাত ধরে এক স্বর্গীয় পরিবেশে পৌঁছে যাবার সৌভাগ্যও কিছু কম নয়। “মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান ” – শ্রী নায়ার এর কন্ঠে এই গানটির সাথে শ্রীমতি চট্টোপাধ্যায়ের অসাধারণ নাচ ও অভিনয় উপস্থিত বহূ দর্শকদের চোখে জল আনে। তাঁর অভিনয়ের ও নৃত্যের মাধ্যমে অনুভূত হয় আমাদের সকলের মধ্যেই আছেন একজন রাধারানী আর সেই রাধারানীর মতো আমাদের ও আছে ঈশ্বরের সাথে মিলনের আকুতি । ভানুসিংহ বন্দিছের শুরু থেকে শেষ চমৎকার সুত্রে বেঁধেছেন শ্রী নায়ার তাঁর কন্ঠের জাদুতে ও শ্রীমতি চট্টোপাধ্যায় তাঁর অনির্বচনীয় নাচ ও অভিনয়ের মাধ্যমে । সমান পারদর্শিতার পরিচয় দেন দুই গুরুর শিষ্যরা। নাচ ,গান, অভিনয় ,ভাষ্যপাঠ , আলো ,পোষাক, এবং যন্ত্রসঙ্গীত এক কথায় অনবদ্য। ভারতনাট্যম আঙ্গিকে হলেও শেষ “আজু সখি মুহূ মুহূ ” গানটি ত়ে মন্দিরা বাজিয়ে শ্রী কৃষ্ণের সাথে রাধারানীর মিলনএর মুহূর্ত কে যথার্থ রূপ দান করে জাহ্নবী দল যেখানে বৈষ্ণব পদাবলী মণিপুরী নাচের সাথে গাটছড়া বেঁধে কোথাও যেন মিলে মিশে এক হয়ে যায় ভানুসিংহের পদাবলীর হাত ধরে । সব শেষে শ্রী নায়ার এর পরিচালনায় হারমোনিয়াম ও শ্রীখোল এর যুগলবন্দীর সাথে হরিধ্বনি ওঠে মঞ্চে যা দীর্ঘ্যদিন মনে থাকবে উপস্থিত সকল দর্শকের। বৈষ্ণব পদাবলীর দ্বারা অনুপ্রেরিত ভানুসিংহের পদাবলীর মূল ভাব হল ভক্তি ও প্রেম রসের মাধ্যমে বিরহ ও মিলন। মঞ্চে উপস্থিত প্রতি শিল্পী এই মূলভাবের পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছেন।
অনুষ্ঠান শেষে সেই দুই ভদ্রলোকের সাথে সাথে আরও বহূ দর্শককে দেখলাম মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছেন মঞ্চের দিকে। বুঝলাম ভানুবাবুর বন্দনা সার্থক! ভানুসিংহ বন্দিছের সকল শিল্পীদের জানাই অভিনন্দন এমন একটি সন্ধ্যা উপহার দেবার জন্য।
ছবি ১: মনোজ মুরলী নায়ার
ছবি ২: মধুবনী চট্টোপাধ্যায়
ছবি ৩: জাহ্নবী ও ডাকঘরের সকল শিল্পীরা
ছবি সৌজন্য : মধুজা মুখোপাধ্যায়