ময়ূখ নস্কর
সারা বছর ধরে একটা ফুটবল ক্লাব চালানোর অনেক ঝক্কি।
প্রথমত, সারা বছরের জন্য স্পন্সর জোগাড় করা,তারপর খেলোয়াড় খুঁজে আনা, কোচ ঠিক করা, খেলোয়াড় কোচদের মাইনে দেওয়া, এছাড়াও অন্যান্য গ্রাউন্ড স্টাফদের মাইনে। এর বাইরে ছোট হলেও একটা স্টেডিয়ামের দেখভাল, মাঠের পরিচর্যা।এর বাইরে ফেডারেশনের ঝক্কি মতো অ্যাকাডেমি করো, লাইসেন্সিং করো। অনেক হ্যাপা।
তুলনায় খেপ টুর্নামেন্টে টিম নামানো অনেক সহজ। কোনও স্টাফ টাফের বালাই নেই, হাতে টাকা থাকলেই হল। অন্য ক্লাবের খেলোয়াড় বেছে বেছে তুলে নাও। তাঁদের পিছনে সারা বছর মেহনতের দরকার নেই। স্টেডিয়াম মাঠ ও সব সরকার বুঝবে। দল জিতলে সরকার সম্বর্ধনাও দেবে। আমি শুধু বগল বাজাব আর মুনাফা লুটব।
বুঝতেই পারছেন খেপ টুর্নামে্ন্ট বলতে আই এস এলের কথা বলছি। আই এস এল একটা খেপ টুর্নামেন্ট ছাড়া কি মশাই! এই আই এস এল করে কী লাভ হচ্ছে? একটাও ফ্রাঞ্ছাইজি অ্যাকাডেমি গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে? একটাও নতুন প্লেয়ার তুলে এনেছে? একটাও নতুন মাঠ হয়েছে? সরকারের স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছে। প্র্যাকটিস হচ্ছে অন্যান্য ক্লাবের মাঠে। যেমন অ্যাটলেটিকোর প্র্যাকটিস হচ্ছে মোহনবাগান মাঠে।
সরকারের সব সুযোগ সুবিধা কাজে লাগাচ্ছে আই এস এল দলগুলি। অথচ লাইসেন্সিংয়ের যত কড়াকড়ি আই লিগের ক্লাবগুলোর জন্য। ভাড়া করা ফুটবলার এনে ৪ মাসের খেপ টুর্নামেন্টে টাকা ঢেলে যদি লাভ করা যায় তাহলে স্পন্সররা সারা বছরের জন্য ক্লাবগুলকে টাকা দেবে কেন? তাই টাকার অভাবে ভুগছে মোহন বাগান ইস্টবেঙ্গলের মতো ক্লাব। মহমেডান মূল স্রতের বাইরে। উঠে গেছে, জে সি টি, মাহিন্দ্রা। কেরল পুলিশ, বি এস এফ, এয়ার ইন্ডিয়া তো আগেই ঝাপ বন্ধ করেছে।
এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে উঠে যাচ্ছে একের পর এক টুর্নামেন্ট। রোভার্স, ফেড কাপ তো আগেই গেছে। আই এফ এ শিল্ড অনূর্ধ্ব ১৯, সন্তোষ ট্রফিও কৌলিণ্য হারিয়ে লুপ্তপ্রায়। এবার শুনছি ডুরান্ডও উঠে যাবে। ভাবা যায়? ডুরান্ড পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম টুর্নামেন্ট। আয়োজন করে সেনাবাহিনি। ফাইনালের দিন হাফ টাইমে আর্মি ব্যান্ড বাজে। সেই টুর্নামেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে? দেখে শুনে মনে হয় দেশ থেকে ফুটবলটা উঠে গেলে ফেডারেশন বাঁচে।
অথচ এই টুর্নামেন্টগুলকে ঘিরে আমাদের কত স্মৃতি। রোভার্স কাপ মানেই গ্যালারিতে মান্না দে, শচীন কর্তা, দিলিপ কুমার। আই এফ এ শিল্ড মানে ইরান থেকে আসবে পাস ক্লাব, সোভিয়েত থেকে আসবে আরারাত, উরুগুয়ে থেকে আসবে পেনারল, ব্রাজিল থেকে আসবে পালমেরাস। ফেড কাপ মানে দেশের সেরা নক আউট টুর্নামেন্ট।ডুরান্ড মানে দরিয়াগঞ্জ চিত্তরঞ্জন পার্ক থেকে দলে দলে আসবেন বাঙালিরা, গ্যালারি থেকে প্রতি ম্যাচে কাঁসর বাজাবেন এক বৃদ্ধ শিখ ভদ্রলোক। কী সুন্দর ছিল সেই ঢং ঢং আওয়াজ। এই সবগুলোই একে একে বন্ধ হয়ে যাবে?
সেদিন এক ইস্টবেঙ্গল সমর্থক আমাকে আওয়াজ দিয়ে বলছিল, “মোহনবাগান তো লক্ষ্মীবিলাস, কোচবিহার, দ্বারভাঙ্গা এই সব টুর্নামেন্ট জিতত।” ছেলেটি ইতিহাস জানে না। একদিন ওই টুর্নামেন্ট গুলি ছিল রীতিমতো নামকরা। পরবর্তীকালে এগুলি বন্ধ হয়ে গেলেও, সিকিম গভরনর্স কাপ, দার্জিলিং গোল্ড কাপ, এয়ারলাইন্স কাপ, কলিঙ্গ, নাগজি, বরদলুই, ডি সি এম, সিজারস, কত টুর্নামেন্ট হতে দেখেছি। সব বন্ধ হয়ে গেছে। তবু ছিল ৪টি ব্লু রিবন টুর্নামেন্ট, রোভার্স, ডুরান্ড, আই এফ এ। এগুলই যদি না থাকে তাহলে আগামি প্রজন্ম জানবে কি করে ত্রিমুকুট জয় কাকে বলে?
তাও যদি ঘটা করে আই লিগ আর ফেড কাপ হত, তা হলে বুঝতাম খেলাতা অন্তত হচ্ছে। কিন্তু সব বন্ধ করে শুধু ৪ মাসের একটা খেপ টুর্নামেন্ট?
খেলা না হলে স্পন্সররা ক্লাবে টাকা দেবে কেন? আর টাকা না পেলে ক্লাব চলবে কী করে? হয় ফেডারেশনের কর্তারা আই এস এলের ক্লাবগুলোকে বাধ্য করুন সারা বছর ধরে ক্লাব চালাতে, টুর্নামেন্ট খেলতে,নয় তো সাধারন ফুটবল প্রেমিরা আই এস এল নিয়ে আদিখ্যেতা বন্দ করুন। যে টুর্নামেন্টে দেশের ফুটবলের কোনও উন্নতি হয় না, বরং ফুটবলের কাঠামোটাই নষ্ট করে দেয়, তা দেখার থেকে বিদেশি লিগ দেখা ভালো।
বলুন, খেপ টুর্নামেন্ট হায় হায়। আই এস এল হায় হায়।


