প্রশাসনিক বৈঠক সম্পর্কে দু–‌একটি অপ্রিয় কথা

লাইভ বৈঠক দেখে যাঁরা আপ্লুত, যে সব মিডিয়া গদগদ, তাঁরা একটু তলিয়ে ভাবুন। সত্যিই কি সমস্যা সমাধানের সদিচ্ছা আছে?‌ তার থেকে দেখনদারিটা কি অনেক বেশি পরিমাণে হয়ে যাচ্ছে না?‌ ‘‌তিনি’‌ই সর্বশক্তিমান, এটা বোঝাতে গিয়ে বাকিদের অসম্মান করাটা কি খুব জরুরি?‌ লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী।।

আগে প্রশাসনিক বৈঠক দেখার তেমন সুযোগ ছিল না। ভেতরে কী আলোচনা হত, জানতেই পারতাম না। এখন টিভির দৌলতে, আরও ভাল করে বলতে গেলে, মুখ্যমন্ত্রীর দৌলতে জানতে পারছি। আগে ভাবতাম, ভারী ভারি কিছু আলোচনা হয়। এখন বুঝলাম, আলোচনা মোটেই উচ্চমানের নয়। গভীরতা নয়, সস্তা চমকটাই এখানে প্রাধান্য পায়।
আপাতভাবে দেখে কী কী মনে হবে?‌ ১)‌ মুখ্যমন্ত্রীকে সবাই ভয় করে। ২)‌ আমলারা গুটিয়ে থাকে, মন্ত্রীরা গুটিয়ে থাকে। ৩)‌ দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী দারুণ সোচ্চার। কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না। ৪)‌ কাজ হচ্ছে কিনা, সেদিকে তার দারুণ নজর। ৫)‌ মানুষের সমস্যা তিনি দারুণ বোঝেন। সঙ্গে সঙ্গে সমাধান করেন।

এমন আরও কত ভাবনা মাথায় আসতে পারে। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখুন তো। যেগুলো সেখানে আলোচনা হয়, সেগুলো তো পঞ্চায়েতে বা পঞ্চায়েত সমিতিতে আলোচনা হতে পারে। কোনও কোনও বিষয় বিধানসভার উল্লেখপর্বে উঠে আসতে পারে। তার মানে, সেগুলোর কোনও গুরুত্ব নেই। সেখানে বললে ফল হবে না, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বলতে হবে।

mamata

মুখ্যমন্ত্রী চটজলদি নির্দেশ দিচ্ছেন, খুব ভাল কথা। আচ্ছা বলুন তো, পাড়ার ছোট্ট একটা রাস্তা করতে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে হবে কেন?‌ এটা পঞ্চায়েত প্রধানেরও দরকার পড়ত না। পাড়ার পঞ্চায়েত মেম্বারকে বললেই হত। পাড়ার পঞ্চায়েত মেম্বার যেটা করতে পারেন, সেটা করতে একজন বিধায়ক বা সাংসদ কিনা দ্বারস্থ হচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রীর। আর মুখ্যমন্ত্রীও দরাজ হস্তে টাকা বিলিয়ে সেগুলি করার নির্দেশ দিয়ে চলেছেন।

তিনি প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে চলেছেন, মন্ত্রী বলে কেউ নেই। তাদের বলে কিছু হবে না। তিনি সব দপ্তরের সেক্রেটারিদের নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন। সেখানে মন্ত্রীদের কোনও জায়গা নেই। বুঝিয়ে দেওয়া, সেক্রেটারিরা মন্ত্রীর কথা শুনবেন না, শুধুমাত্র তাঁর কথাই শুনবেন। ডিএম–‌রা সভাধিপতি বা জেলার বিধায়কদের কথা শুনবেন না। শুধু তাঁর কথাই শুনবেন। এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকেও জোড়হাত করে তাঁর সামনে দাঁড়াতে হবে। তিনি ইচ্ছেমতো ধমকাবেন, অপমান করবেন, তাঁদের মাথা নিচু করে শুনতে হবে। কেউ কোনও পাল্টা কথা বলতে পারবেন না। কেউ কোনও পাল্টা প্রশ্ন করতে পারবেন না। সামান্যতম অপ্রিয় প্রশ্ন এলেই যেন গর্দান যাবে। তিনি প্রমাণ করতে চান, সবাই অপদার্থ, একমাত্র তিনিই কাজ বোঝেন। তিনি প্রমাণ করতে চান, আই এ এস, আই পি এসদের কোনও সম্মান নেই। তাঁরা সবাই তাঁর অধস্থন কর্মচারী মাত্র।
লাইভ বৈঠক দেখে যাঁরা আপ্লুত, যে সব মিডিয়া গদগদ, তাঁরা একটু তলিয়ে ভাবুন। সত্যিই কি সমস্যা সমাধানের সদিচ্ছা আছে?‌ তার থেকে দেখনদারিটা কি অনেক বেশি পরিমাণে হয়ে যাচ্ছে না?‌ নিজের প্রচারের ঢাক পেটাতে গিয়ে একজন মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে এভাবে অপমান করে যাবেন, অপদস্থ করে যাবেন, আর সবাইকে তা হজম করে যেতে হবে?‌ সন্ত্রাসের আবহটা কেমন, একেকটা প্রশাসনিক বৈঠকই তা বুঝিয়ে দিয়ে যায়।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.