স্বরূপ গোস্বামী
কমলালেবুর গ্রাম বলতেই সবার আগে ভেসে ওঠে সিটংয়ের নাম। ঘরে ঘরে থরে থরে কমলালেবুর গাছ। ইচ্ছেমতো পেড়ে নিলেই হল। কমলালেবুর খোঁজে সিটং গিয়ে হতাশও হতে হয়েছে। কমলার সিজন না জানলে যা হয়! মার্চ, এপ্রিলে গেলে কি আর কমলালেবুর দেখা মেলে!
আবার উল্টোটাও হয়েছে। কমলালেবু দেখার কোনও সুদূরতম আশাও ছিল না। কিন্তু একের পর এক কমলার বাগান। ইচ্ছেমতো লেবু পেড়ে নেওয়ার হাতছানি। এটা অবশ্য সিটং নয়, তাবাকোশিতে। তাবাকোশি যাওয়া মূলত চা–বাগানের সান্নিধ্য পেতে। মিরিক পেরিয়ে ছোট্ট এক পাহাড়ি জনপদ। অলসভাবে দু–তিন দিন কাটানোর আদর্শ জায়গা। এখানে যে এমন কমলার বাগান আছে, কে ভেবেছিল!
এক বন্ধুর কাছে প্রথম শুনেছিলাম তাবাকোশির কথা। তবে সে কিন্তু কমলালেবুর কথা বলেনি। আসলে, সে কমলালেবু দেখেইনি। সে গিয়েছিল, এমন সময় যখন কমলালেবু হয় না। তাছাড়া সে তাবাকোশিতে যত না সময় ছিল, তার থেকে বেশি ঘুরেছে আশপাশের জায়গায়। পুরীতে গিয়ে সবাই যা করে। আশপাশের উদয়গিরি, খণ্ডগিরি, কোনারক, নন্দন কানন এসবের চক্করে পড়ে আর পুরীটাই ঘোরা হয় না। তারও হয়ত তেমন দশাই হয়েছিল। আশপাশ ঘুরতে গিয়ে পায়ে হেঁটে তাবাকোশিটাই ঘোরা হয়নি। আমরা অবশ্য তাবাকোশি গিয়ে সেই ভুলটা করিনি। ঠিক করেই নিয়েছিলাম, নো সাইট সিন। অলসভাবে দুটো দিন তাবাকোশিতেই কাটাব।
মিরিক বলতে ছোটবেলায় দেখা মিরিক লেক। সে এক নস্টালজিয়া। মনে আছে, প্রথম বোটিং করেছিলাম এই মিরিকেই। মনের মধ্যে একটা ছবি আঁকাই ছিল। কিন্তু সেই লেকের এ কী দশা! যেন এঁদো পুকুর। দেখেই আর দাঁড়াতে ইচ্ছে হল না। অন্য সময় লেকটা বেশ সেজেই থাকে। বোটিং তো আছেই, সেইসঙ্গে আছে ঘোড়ায় চড়ার হাতছানিও। কিন্তু লকডাউনে পর্যটকের দেখা নেই বলেই হয়ত সেভাবে সেজে ওঠেনি।
মিরিক ছাড়িয়ে আমরা সোজা চললাম তাবাকোশির দিকে। মিরিক ছাড়ালেই উঁচু উঁচু পাইন গাছের সারি। কোথাও মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। কোথাও হঠাৎ অন্ধকার নেমে আসছে। দু পাশে ঢেউ খেলানো চা–বাগান। প্রতিটি রাস্তার বাঁক যেন একেকটা ভিউ পয়েন্ট। অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার পর ডানদিকে একটা ঢালু রাস্তা নেমে গেছে। দু পাশে শুধু চায়ের সাম্রাজ্য। এই পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া আরও বেশি রোমাঞ্চকর। কিন্তু তখন তো ঠিকানায় পৌঁছতে হবে। তাছাড়া গাড়িতে ব্যাগপত্তর কম ছিল না। তাই হাঁটার রোমান্টিকতা মুলতুবি রেখে গাড়িতেই বাকি পথটা পাড়ি দিতে হল।
অনেকটা পথ যাওয়ার পর একটা পাহাড়ি নদী। সেই নদী না হয় পেরোলাম, এবার দুদিকে দুটো রাস্তা বেঁকে গেছে। একটা বাঁদিকে, একটা ডানদিকে। কোনদিকে যাব? চালক মশাইও বেশ বিভ্রান্ত। এদিকে, জিজ্ঞেস করব, তারও উপায় নেই। কারণ, ধারেপাশে কাউকে দেখাও যাচ্ছে না। হোম স্টের মালিককে ফোন করে ডানদিকের রাস্তাই নিলাম। গাড়িটা এসে থামল টি ভিলেজ হোম স্টে—তে। আগামী দুদিন এটাই আমাদের ঠিকানা। বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন বিজয় সুব্বা। হোম স্টে তে ঢোকার আগেই একের পর এক চমক। একেবারেই লাগোয়া চা বাগান। যে ঘরে থাকার ব্যবস্থা, তার জানালা খুললেই চা–বাগান। অন্য সময় কিছুটা রুক্ষ মনে হবে। কিন্তু বর্ষায় তার চেহারাই আলাদা। বাড়ির লাগোয়া দারুণ এক বাগান। ফুল কপি থেকে মটরশুটি, পেলে থেকে কলা, বাঁধা কপি থেকে মুলো, সসা থেকে টমাটো। কী নেই সেই ছোট্ট বাগানে। পরিচর্যার ছাপ স্পষ্ট। পাশেই একটা ছোট্ট চৌবাচ্চার মতো জলাশয়। সেখানে খেলে বেড়াচ্ছে রঙ বেরঙের মাছ।
দুপুরে খাওয়ারের মেনুও জিভে জল আনার মতোই। এমনিতে পাহাড়ের হোম স্টেতে একটা অলিখিত নিয়ম আছে। দিনে ডিম, রাতে চিকেন। কিন্তু বাঙালি গেস্ট দেখে বিজয়জি আগাম মাছের বন্দোবস্ত রেখেছিলেন। মাছে ভাতে বাঙালির জন্য মাছের অন্যরকম আয়োজন। তার কী নাম, জানা নেই। তবে খেতে বেশ। এমনিতে ভাত, ডাল, নানারকমের সবজি, চাটনি, পাপড়, বিচিত্র স্যালাড — এসব তো ছিলই। সবমিলিয়ে অন্য সময় যা খাওয়া হয়, তার থেকে অনেক বেশিই খাওয়া হয়ে গেল।
যতই আসার ক্লান্তি থাকুক। দুপুরে গড়িয়ে নেওয়ার কোনও মানেই হয় না। কারণ, পাহাড়ে সন্ধের পর তেমন কিছুই করার থাকে না। তাই যেটুকু ঘোরার, এই দুপুরেই ঘুরে নিতে হবে। বিজয়জির বাগানে একটা কমলালেবুর গাছ দেখে কৌতূহল হল। তিনি বললেন, একটা গাছ দেখেই এত এক্সাইটেড হচ্ছেন। সামনের দিকে একটু এগিয়ে গেলে হাজার হাজার গাছ দেখতে পাবেন। বোকা বোকা প্রশ্নটা করেই ফেললাম, লেবু পাওয়া যাবে? উনি হেঁসে বললেন, হাজার হাজার গাছ মানে লক্ষ লক্ষ লেবু। আমাদের রোমাঞ্চ তখন দেখে কে! ওই অবস্থাতেই বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের সঙ্গে বিজয়জির এক আত্মীয়। তিনিই আমাদের গ্রাম ঘোরাতে নিয়ে গেলেন। দেখলাম, বিজয়জি একটুও বাড়িয়ে বলেননি। সত্যিই, একেকটা ঘরে লেবু গাছের মিছিল। কিন্তু লোকের ঘরে ঢুকে লেবু পাড়া কি ঠিক হবে? এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই একের পর এক বাড়ি, একের পর এক বাগান পেরিয়ে গেলাম। শেষমেষ লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে একটা ঘরে ঢুকেই পড়লাম। মৃদু হেসে বললাম, আপনাদের লেবু বাগানে গিয়ে দু একটা লেবু নিতে পারি? তাঁরা পাল্টা হাসি উপহার দিয়ে বললেন, আপনারা আমাদের গ্রামের অতিথি। একটা দুটো কেন, যত খুশি পাড়ুন।
সেই আশ্বাস পেয়েই চলে এলাম বাগানের দিকে। সাইজ একটু ছোট। কিন্তু হাজার হাজার লেবু ধরে আছে গাছে। গাছের গায়ে হেলান দেওয়া সিঁড়ি কাঠ যেমন আছে, তেমনি একজন এগিয়ে দিলেন আঁকশি। অর্থাৎ, ইচ্ছমতো পেড়ে নিন। একের পর এক লেবু পাড়ার পর্ব চলল। যখন ফিরে আসছি, তখন দেখি আমাদের জন্য তাঁরা চা বানিয়ে রেখেছেন। উঠোনেই চেয়ার পেতে দিলেন। এমন আতিথেয়তা সত্যিই মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। তখনও আরও চমক বাকি ছিল। বেরিয়ে আসার মুখে একজন ধরিয়ে দিলেন একটা থলি। সেখানে কেজি খানেক লেবু তো আছেই। মানি ব্যাগ বের করতে যাব, অমনি একজন নমস্কারের ভঙ্গিতে বললেন, প্লিজ এটার দাম দেবেন না। এটা আমাদের ছোট্ট উপহার। আপনারা আমাদের গ্রামে ঘুরতে এসেছেন। এই লেবুগুলো তারই মেমেন্টো।
একরাশ কৃতজ্ঞতা আর মুগ্ধতা নিয়ে ফেরার রাস্তা ধরলাম। দু পাশে ঘন চা বাগান মোড়া সেই রাস্তায় একটু একটু করে বিকেল নামছে।
****
কীভাবে যাবেন?
এনজেপিতে নেমে সরাসরি গাড়ি নিতে পারেন। খরচ কমাতে চাইলে শেয়ারে মিরিক এসে, সেখান থেকেও গাড়ি নিতে পারেন।
কোথায় থাকবেন?
বেশ কয়েকটা হোম স্টে আছে। সবগুলোই ভাল। তবে আমরা ছিলাম টি ভিলেজ হোম স্টেতে। ফোন— ৯৪৩৪১৩১৭৩৭