মাথা উঁচু রেখেই বিদায় নিন দুই মহাতারকা

দেবায়ন কুণ্ডু

কয়েকদিন আগেই পেরিয়ে এসেছেন টেস্টে দশ হাজার রানের মাইলস্টোন। দশ হাজার বলতে এখন যেমন আটপৌরে ব্যাপার বোঝায়, আটের দশকে মোটেই তেমন ছিল না। তখনও সেটা ছিল সম্পূর্ণ অচেনা এক পর্বতশৃঙ্গের মতোই। কত কত পর্বত অভিযাত্রী এভারেস্ট অভিযানে যাচ্ছেন। এখন আর কেউ খোঁজও রাখে না। কিন্তু এভারেস্ট বলতেই মনে পড়ে তেনজিং নোরগে আর এডমন্ড হিলারির কথা। ঠিক তেমনই, টেস্টে দশ হাজার বললেই সবার আগে মনে পড়ে সুনীল গাভাসকারের মুখটাই।

পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির সানির ক্রিকেটীয় উচ্চতা তখন হিমালয়সম। চাইলেই অনায়াসে আরও বছর চার–‌পাঁচ খেলে দিতে পারতেন। রান সংখ্যা চোদ্দ বা পনেরো হাজারে পৌঁছেও যেত। কিন্তু সানির মনে হয়েছিল, এবার থেমে যাওয়া দরকার। কাউকে না জানিয়ে হঠাৎ করেই সরে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই ঘোষণা এসেছিল সুদূর লর্ডস থেকে। সেদিন সানি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ঠিক সময়ে থামতে জানাটাও একটা আর্ট।

ভারতীয় ক্রিকেটে এত এত তারকার আগমন ঘটল। কজন আর ঠিক সময়টা বেছে নিতে পারলেন?‌ মহাতারকা শচীন তেন্ডুলকারের কথাই ধরা যাক। অবসর নিয়েছেন ২০১৩ তে। কিন্তু মোটামুটি ২০০৭–‌০৮ থেকেই সাংবাদিক সম্মেলনে ঘুরেফিরে এসেছে অবসরের প্রসঙ্গ। উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন শচীন। কপিলদেব। হেডলির সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড টপকে যাবেন বলেই বেশ কয়েক বছর ধরে কার্যত তাঁকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে। এবার অবসর না নিলে হয়তো বাদই পড়তে হত। সৌরভ গাঙ্গুলি। ঢাকঢোল পিটিয়ে বিদায় অভ্যর্থনা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এক্ষেত্রেও অবসর নিতে কার্যত বাধ্যই করা হয়েছে। বার্তাটা ছিল পরিষ্কার, তোমার কামব্যাক হয়েছে, একশো টেস্ট খেলা হয়ে গেছে, এবার সম্মান থাকতে থাকতে কেটে পড়ো বাপু। নইলে আবার বাদ যেতে হতে পারে। তখন যেন গাঁইগুঁই কোরো না। তখন আর কোনও সহানুভূতি থাকবে না।

দেওয়াল লিখন বুঝতে পেরে সরে দাঁড়ালেন অনিল কুম্বলেও। রাহুল দ্রাবিড়ের মতো ‘‌মিস্টার ডিপেন্ডেবল’‌কেও যখন সরে দাঁড়াতে হল, তখন তিনি ভারতীয় স্কোয়াডের সদস্যই নন। নিজের শর্তে বিদায় নিতে পেরেছেন একমাত্র মহেন্দ্র সিং ধোনি। অন্তত টেস্ট থেকে তাঁর অবসর ছিল একেবারেই আকস্মিক। দল অস্ট্রেলিয়া সফরে, তিনি অধিনায়ক, হঠাৎ ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের জানিয়ে দিলেন, আমি আমার জীবনের শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলে ফেলেছি। এবার আলবিদা। বীরেন্দ্র শেহবাগ, হরভজন সিংরা কবে অবসর নিয়েছেন, তাঁরা নিজেরাও ভুলে গেছেন। কারণ, অবসরের অনেক আগেই তাঁরা চলে গিয়েছিলেন ব্রাত্যজনের তালিকায়।

এখন প্রশ্ন, বিরাট কোহলি বা রোহিত শর্মা কী করবেন?‌ টি২০ থেকে আগেই সরে দাঁড়িয়েছেন। বিদায় ঘোষণার জন্য দারুণ মঞ্চ বেছে নিয়েছিলেন। বার্বাডোজের মাটিতে ১৭ বছর পর ভারত টি২০ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন। এর থেকে ভাল মুহূর্ত আর কী হতে পারত?‌ টেস্টেও ইংল্যান্ড সফরের আগে হঠাৎ করে দুজনেই অবসর ঘোষণা করলেন। অনেকের ধারণা ছিল, ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর হয়তো অবসরের রাস্তায় হাঁটতে পারেন। কিন্তু একদিনের ক্রিকেট?‌ জোর জল্পনা, তাঁরা নাকি ২০২৭ বিশ্বকাপে খেলতে চান। কিন্তু এখনই বলে দেওয়া যাক, তেমন সম্ভাবনা চোখে হাইপাওয়ারের দূরবিন লাগিয়েও দেখা যাচ্ছে না। শুধু ৫০ ওভারের ক্রিকেটে খেলে আগামী দু’‌বছর ফিটনেস আর ফর্ম ধরে রাখা শুধু মুশকিল নয়, কার্যত অসম্ভব। একজনের বয়স ৩৮, একজনের ৩৭। দু’‌বছর পর দুজনেরই বয়স আরও দু’‌বছর করে বাড়বে। এখনই তাঁদের অবসর নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশ্ন আসছে। অস্ট্রেলিয়ায় ব্যর্থ হলেই গেল গেল রব উঠে যাবে। এই দু’‌জনকে কেন সরানো হচ্ছে না, এমন আওয়াজ তুলতে শুরু করে দেবেন বিশেষজ্ঞরা। বোর্ডও যে তাঁদের চাইছে না, দেওয়াল লিখন পরিষ্কার। কোচ গৌতম গম্ভীর তো একেবারেই চাইছেন না। এই পরিস্থিতিতে বিরাট–‌রোহিতের অস্ত্র হতে পারত হাতের ব্যাট। কিন্তু ব্যাটেও সেই ধার আর নেই। পাঁচটা ম্যাচে ব্যর্থ হবেন, একটা ম্যাচে হয়তো রান পাবেন। দিনের শেষে সেই ‘‌ব্যর্থ’‌ই বলা হবে।

তাহলে কী করবেন এই দুই মহাতারকা?‌ অন্তত টি২০ আর টেস্টে তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা ঠিক সময়ে থামতে জানেন। একদিনের ক্রিকেটে পিচ বোঝার ক্ষেত্রে কি এতবড় ভুল করবেন?‌ হয়তো অস্ট্রেলিয়া সফরের পরই আসতে পারে চমকপ্রদ কোনও ঘোষণা। অবশ্য, বিরাট–‌রোহিতদের অবসর এখন কতখানি ‘‌চমকপ্রদ’, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতেই পারে। বিরাট–‌রোহিতের মতো তারকা বাদ পড়ছেন, তারপর হতাশ হয়ে ইনস্টাগ্রামে অবসর ঘোষণা করছেন, এমন দিন কেউই দেখতে চান না। তাঁদের বিদায় হোক বর্ণাঢ্য। এই বর্ণাঢ্য বিদায় তাঁদের প্রাপ্য। আশা করি, বোর্ড কার্পণ্য দেখাবে না। ‌
‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *