স্বরূপ গোস্বামী
এতদিন তিনি অন্যের আসনসংখ্যা বলে এসেছেন। মোটামুটি মিলেও যেত। কিন্তু এবার তিনি অন্য মাঠে। অন্য এক ইনিংসের অপেক্ষায়।
যিনিই ইন্টারভিউ করতে আসছেন, একটা কমন প্রশ্ন। জন সুরাজ কটা আসন পেতে পারে? পিকে–র উত্তর তৈরিই আছে, হয় দশের কম, নইলে একশো পঞ্চাশের বেশি। মাঝামাঝি কোথাও থাকব না।
তিনি তাহলে কার সঙ্গে জোট করছেন? এখানেই ছিল স্পষ্ট উত্তর, কারও সঙ্গে না। ২৪৩ আসনেই আমাদের প্রার্থী থাকবে। ভোটের আগে যেমন জোট হবে না, ভোটের পরেও কোনও জোট হবে না।
নীতীশ কুমারের জেডিইউ কটা আসন পেতে পারে? এক্ষেত্রেও সাফ কথা, লিখে নিন, পঁচিশের বেশি আসন কখনই পাবে না।
অন্য দলে যারা টিকিট পাবেন না, তাঁরা আপনার দলে এসে ভিড় করবেন। এক্ষেত্রেও বলটা সটান গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, ‘কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের প্রার্থী তালিকা সবার আগে ঘোষণা হবে। তাই অন্য কোন দলে কে টিকিট পেল, আর কে পেল না, তা দেখার সুযোগই নেই।’
রাজনীতিতে নাকি একটু রেখেঢেকে বলতে হয়। ভবিষ্যতের দরজা খুলে রাখতে হয়। একটু ধোঁয়াশা রাখতে হয়। কিন্তু তাঁর কথায় কোনও ধোঁয়াশা নেই। যা বলছেন, একেবারে স্পষ্ট বলছেন। আগেই বলে দিয়েছিলেন, ‘আমাদের যাঁরা প্রার্থী হবেন, তাঁদের আশি শতাংশ এমন থাকবেন, যাঁরা আগে কোনওদিন প্রার্থী হওয়া তো দূরের কথা, সক্রিয় রাজনীতিতেই ছিলেন না।’
ভোট দুয়ারে কড়া নাড়ছে। গত কয়েক মাস ধরে প্রশান্ত কিশোর যা যা বলে আসছিলেন, তার অধিকাংশই কথা রেখেছেন। সত্যিই, তাঁর দল সব আসনেই প্রার্থী দিয়েছে। সত্যিই অন্য কোনও দলের সঙ্গে সমঝোতা করেননি। সত্যিই, বেশিরভাগ প্রার্থী এসেছেন রাজনীতির বাইরে থেকে। সত্যিই, দলবদলুদের টিকিট দেননি। শুধু তাই নয়, সাফ বলে দিচ্ছেন, জনসুরাজের একজন প্রার্থীকেও যদি মনে হয় ইনি ভাল প্রার্থী নন, তাহলে আমি বলছি, তাঁদের হারিয়ে দিন। যে যোগ্য প্রার্থী, তাঁকে জেতান।
সবমিলিয়ে বিহারের রাজনীতিতে একেবারে অন্য এক মাত্রা এনে দিয়েছেন একদা ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর। একসময় তিনি অন্যদের বুদ্ধি জোগাতেন। ছিলেন কিংমেকার। এবার সরাসরি কিং হওয়ার দৌড়ে।
হঠাৎ করে দল খুলে ফেললেন, এমন নয়। টানা তিন বছর বিহারের গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন। গাড়িতে নয়, পুরোটাই পায়ে হেঁটে। শুরুতে একেবারেই সাড়া ছিল না। থাকার কথাও নয়। কে কোথাকার প্রশান্ত কিশোর, তিনি দল গড়ে অন্যদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেবেন, এতখানি অতিবড় আশাবাদীর পক্ষেও ভাবা সম্ভব ছিল না। মনে হয়েছিল, কয়েকদিন গেলেই রূঢ় বাস্তবটা বুঝতে পারবেন। রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যাবেন। কিন্তু তিন বছর ধরে পড়ে রইলেন মাটি কামড়ে। দল গঠনের আগে এত লম্বা প্রক্রিয়া ভারতীয় রাজনীতিতে অন্তত দেখা যায়নি।
আজ তিনি সবার কাছেই ত্রাস। কেউ বুঝে উঠতে পারছেন না, তিনি কার ভোটে থাবা বসাবেন। এমন এমন প্রেস কনফারেন্স করছেন, ভারতীয় রাজনীতিতে যা বিরল। কোথা থেকে এমন গোপন নথি তাঁর কাছে চলে আসছে, তিনিই জানেন। হাওয়ায় ভাসানো ভুয়ো অভিযোগ নয়, একের পর এক নথি তুলে দিচ্ছেন। অনেক রাঘব বোয়াল এর মধ্যেই ঘর ঢুকে গেছেন। পালিয়ে বাঁচার পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।
গত কয়েক মাসে প্রচারকে এমন তুঙ্গে নিয়ে গেছেন, ফোন খুললেই তিনি। কখনও লম্বা ইন্টারভিউ। কখনও ছোট ছোট রিলস। শুধু অন্যদের আক্রমণ নয়, নতুন নতুন ভাবনা। নতুন দিশার সন্ধান। যদি শুধু শিক্ষিত ও সচেতন শ্রেণী ভোট দিতেন, এখনই বলে দেওয়া যায়, তাঁর কাছে অন্য কেউ দাঁড়াতে পারতেন না। কিন্তু জাত–পাত নির্ভর, খয়রাতি নির্ভর রাজনীতিতে তাঁর ইতিবাচক বার্তা নীচের দিকে কতটা পৌঁছোবে, সংশয় থেকেই যায়।
অন্তত মাস ছয়েক আগে বলেছিলেন, বিজেপি শুধু একবার বলে দিক, এনডিএ ক্ষমতায় এলে নীতীশ কুমারই মুখ্যমন্ত্রী হবেন। আজও না মোদি, না অমিত শাহ— কেউই জোরের সঙ্গে এমনটা বলতে পারেননি। সমালোচনা যেমন করছেন, তেমনই প্রশংসাতেও কার্পণ্য নেই। অকপটেই স্বীকার করেন, ‘লালুপ্রসাদ যাদবের লড়াইয়ের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। অসুস্থ থাকলেও বিরাট অংশের মানুষের কাছে তিনি এক মসিহা।’ আবার নীতীশ কুমার সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিতেও কার্পণ্য নেই, ‘নীতীশবাবু জাত–পাতের রাজনীতি করেননি। বরাবরই উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিযেছেন। সুশাসন এনেছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সৎ। অন্তত আর্থিক দুর্নীতির কোনও অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে করা যাবে না।’ প্রতিপক্ষের প্রতি এই সৌজন্যও ভারতীয় রাজনীতিতে বেশ বিরল।
কতগুলো কাজ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এমনও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘একশো দিনের মধ্যে যদি এই কাজগুলো করতে না পারি, তাহলে পদত্যাগ করে চলে যাব। আর ফিরেও তাকাব না।’ কোনটা স্বল্পমেয়াদি, কোনটা দীর্ঘমেয়াদি, সেই সীমারেখাটা বোঝেন, সুন্দরভাবে তুলে ধরতেও জানেন। যে কোনও অপ্রিয় প্রশ্ন যুক্তি দিয়ে সামলাচ্ছেন। গায়ের জোর বা গলার জোর নয়, শিক্ষা আর যুক্তির জোরটাই বড় বেশি করে ধরা পড়ছে। ভারতীয় রাজনীতিতে দিনদিন মূর্খদের দাপট বাড়ছে। এবং এই মূর্খতা সর্বত্রই সংক্রমিত হয়ে পড়ছে। এই আবহে ঝকঝকে শিক্ষিত একজনের হাতে শাসনক্ষমতা গেলে গণতন্ত্রেরই মঙ্গল।
কিন্তু দিনের শেষে একটাই কথা। কটা আসন পাবেন। রাজনীতিতে চলতি কথা, যো জিতা, ওহি সিকান্দার। কিন্তু তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বিরোধী রাজনীতি করব না। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাই, রাস্তাতেই থাকব। আমার দলের অন্যদেরও বলে দেব, তোমরা যে কোনও দলে চলে যেতে পারো। আমি আবার শূন্য থেকে শুরু করব।
ভারতীয় রাজনীতিতে সত্যিই এমনটা দেখা যায়নি। হয়তো চূড়ান্ত হতাশ করবেন, নইলে ইতিহাস নির্মাণ করবেন। যদি একবার ‘চমৎকার’ হয়ে যায়, এটুকু বলা যায়, ভারতীয় রাজনীতির দিশাই বদলে যাবে। বিহারের এই নির্বাচন তখন মাইলস্টোন হয়ে থাকবে।
