যত দোষ, দিলীপ ঘোষ

‌মন কী বাত

সরল বিশ্বাস

কতকাল আগে থেকে একটা কথা শুনে আসছি, যত দোষ, নন্দ ঘোষ। এখন বোধ হয় প্রবাদটা বদলে দেওয়া যেতে পারে। বলা যেতেই পারে, যত দোষ, দিলীপ ঘোষ।

এখন আমি দলের সভাপতি নই, এমপি–‌ও নই। দলের কর্মসূচিতেও আমার ডাক পড়ে না। প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলে আমার কথা কারও মনেও পড়ে না। কী জানি, আমার সঙ্গে এক স্টেজে বসতে তাঁদের কীসের আপত্তি!‌ আমি কোথাও নেই, তবু আমাকে নিয়েই যত বিড়ম্বনা। কখনও শুনি আমাকে নাকি সেন্সর করা হয়েছে। আমি নাকি মুখ খুলতে পারব না। আমি কথা বললে দল নাকি বিড়ম্বনায় পড়ছে। এতে নাকি দলের ভাবমূর্তি খারাপ হচ্ছে। এসব শুনিয়ে আমার কাছেই কিনা প্রতিক্রিয়া চাওয়া হচ্ছে।

আমাকে নাকি চিঠি হয়। অথচ, সেই চিঠি আমার কাছে আসে না। তার আগেই দেশ দুনিয়া জেনে যায়। কেন আমার মুখ বন্ধ করা হল, তা নিয়ে অন্যরা মুখ খুলতে শুরু করে দিল। সন্ধেবেলায় যথারীতি চণ্ডীমণ্ডপও বসে গেল। সেই চিঠি এর তার মোবাইলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাই সেই চিঠি পড়ে ফেলল। শুধু আমারই পড়া হয়নি।

এতদিন শুনতাম, আমার কথা শুনে তৃণমূল রেগে যেত। এখন আমার দলের লোকেরাই রেগে যাচ্ছে। আমি যেখানে যাচ্ছি, আমার দলের লোকেরাই বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। আসলে, আমি গ্রামের মানুষ। এত প্যাঁচ পয়জার বুঝি না। যেটা মনে আসে, সেটাই বলে ফেলি। কে রাগবে, কে খুশি হবে, এসব মাথায় রাখি না। আগে ভাবতাম, আমার কথায় তৃণমূলের আঁতে ঘা লাগে। এখন বুঝছি, আমার কথায় আমার দলের লোকেদেরও আঁতে ঘা লাগে। চার বছর আগে, বিধানসভা ভোটের পর থেকেই আমাকে ঘিরে বিড়ম্বনা শুরু হয়েছে। আসলে, সেবার আমি বেফাঁস কিছু বলে বসেছিলাম। লোকের স্মৃতি বড় দুর্বল। তবু একবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক, আমি ঠিক কী বলেছিলাম। ১)‌ যারা বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে গেল, তারা কেউ আমার হাত ধরে বিজেপিতে আসেনি। যাদের হাত ধরে এসেছে, তাদের জিজ্ঞেস করুন। ২)‌ যারা দিল্লিতে গিয়ে যোগদান করেছেন, তাদের দিল্লির জল হজম হচ্ছে না। ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরে গেছে। ৩)‌ কেন তারা তৃণমূলে ফিরে গেল, সেটা পরে ভাবা যাবে। কেন তারা এসেছিল, কেন তাদের নেওয়া হয়েছিল, এখন সেটাই আগে ভাবতে হবে। ৪)‌ শুধু সিবিআই হলেই হবে না। তদন্তের রেজাল্ট চাই। নইলে মানুষের আস্থা থাকবে না।

এর মধ্যে কোনটা ভুল?‌ আসলে, দিল্লির নেতারা বুঝেছেন, তাঁদের চালাকিটা আমরা ধরে ফেলেছি। লোকসভায় আমরা ১৮ খানা আসন পেয়েছিলাম। আরও দু’‌খানা অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়েছে। বিধানসভায় আমরা আসছিই, মোটামুটি নিশ্চিত ছিল। না, আমাদের বিরাট কোনও সংগঠনও গড়ে ওঠেনি। মূলত বাম ভোটের বড় একটা অংশ আমাদের দিকে এসেছিল। মোদ্দা কথা, যারা তৃণমূলকে পছন্দ করে না, তারা আমাদের ওপর ভরসা রেখেছিল। কিন্তু আমরাই পারিনি সেই ভরসার যোগ্য হয়ে উঠতে।

তৃণমূলের অনেকেই দেওয়াল লিখনটা পড়তে পেরেছিলেন। তাঁরাও বুঝেছিলেন, বিজেপি আসছে। তাই এইদিকে ভিড়েছিলেন। ‌আমাদের দিল্লির নেতারাও বোধ হয় তেমনটাই চেয়েছিলেন। তাঁদের কাছেও তো ইন্টালিজেন্স রিপোর্ট থাকে। তাঁরা জানতেন, তৃণমূলকে টিকিয়ে রাখার একটাই উপায়। দলটা তৃণমূলের ছাঁটমালদের এনে বোঝাই কর। এইসব লোককে জামাই আদর করে এনে যদি টিকিট দাও, তাহলে এরা কিছুতেই জিতবে না। এদের ভোট দেওয়ার থেকে মানুষ বরং তৃণমূলকেই দেবে। কারণ, এলাকায় এইসব লোকের যা ইমেজ, তাতে এদের ভোট পাওয়ার কথা নয়।

মোদ্দা কথা, দিল্লির নেতারা চাননি এখান থেকে তৃণমূল সরে যাক। কেন চাননি, সে তাঁদের সমীকরণ। তাঁরা চেয়েছিলেন, কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে বিরোধীরা যেন একজোট না হতে পারে। সেই কারণে বিভিন্ন রাজ্যে কয়েকটা আঞ্চলিক দলকে অক্সিজেন দিতে হবে। সেই তালিকায় তৃণমূলও আছে। মোদ্দা কথা, তৃণমূল যদি এখানে হেরে যায়, তাহলে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। তখন বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের সামনে কংগ্রেসের দিকে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না। কিন্তু তৃণমূল যদি এখানে টিকে যায়, তাদের উচ্চাকাঙ্খা আরও বেড়ে যাবে। দিদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভিন্ন রাজ্যে প্রার্থী দেবেন। তাতে কংগ্রেসেরই ভোট কাটবে। আখেরে লাভ হবে বিজেপির। অসম, গোয়া বা ত্রিপুরাতে সেটাই দেখা গেছে। এটাই ছিল ফর্মুলা। সেইসঙ্গে অন্যান্য কয়েকটা আঞ্চলিক দলকেও কংগ্রেসের কাছাকাছি যেতে দেবে না। তাই তৃণমূলকে একটু অক্সিজেন দিয়ে টিকিয়ে রাখা। সেই কারণে সিবিআই–‌ইডি লোকদেখানো তদন্ত করে। কাজের কাজ কিছুই করে না। নইলে তৃণমূলের বেলুন কবে চুপসে যেত।

কিন্তু ২০২১ এ কোনওভাবেই তৃণমূলকে টিকিয়ে রাখা যেত না। মানুষের ঘৃণা এতটাই তীব্র ছিল, যে কোনও উপায়ে তাঁরা তৃণমূলকে সরাতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তাহলে উপায়!‌ উপায় একটাই। তৃণমূল থেকে ভুসি মালদের আনো। তাদের টিকিট দাও। যেন তাদের ওপর রাগ করে মানুষ বিজেপিকে ভোট না দেয়। অথচ বিজেপি যদি এইসব লোকেদের প্রার্থী না করত, অনায়াসে জিতে যেত। সেটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দিল্লির নেতারা চলেন তাঁদের নিজেদের হিসেবে। সব বুঝি। কিন্তু দলের বাইরে তো আর এসব বলতে পারি না। তাই এতদিন আমি আমার মতো করে কর্মীদের চাঙ্গা করার চেষ্টা করে গেছি।

আসলে, নীচের তলার কর্মীরাও দিল্লির এই চালাকিটা ধরে ফেলেছিলেন। তৃণমূল থেকে সাময়িক রাগে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরাও বুঝেছিলেন, দিল্লি কখনই চায় না এই রাজ্যের সরকারকে সরাতে। বুঝতে পেরে তাঁরাও কেটে পড়েছেন। বামেদের যে অংশটা আমাদের দিকে এসেছিল, তাঁরাও বুঝতে পেরেছেন, এই বিজেপি আর যাই হোক তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করার মঞ্চ নয়। কেন তদন্ত থেমে যায়, কেন সিবিআই ঘুমিয়ে থাকে, এটা এখন জলের মতো পরিষ্কার।

লোকসভায় সেটা আরও পরিষ্কার হয়ে গেল। সবার কেন্দ্র এক রইল, শুধু আমার কেন্দ্র বদলে গেল। যে মেদিনীপুরে এত পরিশ্রম করে পদ্ম ফুটিয়েছিলাম, সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হল বর্ধমান–‌দুর্গাপুরে। ফল কী হল?‌ মেদিনীপুরেও হার, বর্ধমানেও হার। বিভিন্ন জায়গায় অবাধে ভোট লুঠ হল। কেন্দ্রীয় বাহিনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। এমনকী গণনাকেন্দ্র থেকেও সকাল আটটায় সবাইকে মেরে বের করে দেওয়া হল। তারপরও না নির্বাচন কমিশন, না কেন্দ্রীয় বাহিনী, কেউ কিছু করতে পারল না। আসলে, বিশেষ একজনকে ওয়াকওভার দেওয়ার জন্য যা যা করা দরকার, তাই তাই করা হয়েছে। স্বয়ং নাড্ডাজির কনভয়ে হামলা হয়েছে। তারপরেও আমরা হাত গুটিয়ে থেকেছি। দুর্বত্তরা দিব্যি বুঝে গেছে, এই কেন্দ্রীয় বাহিনি বা নির্বাচন কমিশনের মুরোদ কতখানি। আমরা অপারেশন সিন্দুর করি, কিন্তু বাংলায় ঠিকঠাক একটা ভোট করাতে পারি না।

সিবিআই, ইডি শুনেই আমাদের কর্মীদের কেউ কেউ আনন্দে লাফায়। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, এতে উল্লাস দেখানোর কিছু নেই। ঠিক সময় সিবিআই আবার ঘুমিয়ে পড়ে। কাজের কাজ কিচ্ছু করে না। আরজি কর কাণ্ডে সেটা আরও পরিষ্কার। এত এত শিক্ষকের চাকরি গেল। কিন্তু যারা আসল অপরাধী, তাদের একশো মাইলের মধ্যেও সিবিআই পৌঁছোতে পারছে না। কোন সমীকরণে ঘুমিয়ে পড়ে, একটা বাচ্চা ছেলেও আজ বোঝে। তাই বলেছিলাম, শুধু তদন্ত হলে হবে না। রেজাল্ট চাই। কী জানি, আরও হয়ত গোপন কথা ফাঁস করে ফেলতাম। তাই তড়িঘড়ি আমার মুখ বন্ধের ফতোয়া এল।

আমার জগন্নাথ মন্দিরে যাওয়াটা নেহাতই একটা উপলক্ষ্য। আসলে, যাকে দেখতে পারি না, তার চলন বাঁকা। যেভাবে হোক, আমাকে কোণঠাসা করতে হবে। আমাকে বেইজ্জত করার জন্য একের পর এক ভিডিও বাজারে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আরে বাবা, আমি দিঘায় গেলে যত আপত্তি। আর কেউ কেউ যখন গোপনে, রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন, তখন কোনও সমস্যা নেই। এতদিন আমরা যাকে–‌তাকে বলতাম, চটিচাটা। এখন সেটা দেখছি, ব্যুমেরাং হয়ে আমার দিকেই ফিরে আসছে। আমি যতবার বলছি, তৃণমূলে যাব না, আমাকে না পাঠানো পর্যন্ত কেউ কেউ যেন শান্তি পাচ্ছে না। নতুন নতুন জল্পনা উস্কে দিচ্ছে। আরে বাবা, সিবিআই–‌ইডিকে আমি চালাই না। আমি ঘুম পাড়িয়ে রাখি না। এতদিন বুদ্ধিজীবীদের গালমন্দ করতাম। ওদের চটিচাটা বলতাম। বেশ বুঝতে পারছি, আসল চটিচাটা লোকেরা আমাদের দলেই রয়েছে। এবং তারা এ রাজ্যে নয়। বসে আছে অনেক উঁচুতে।

(‌বিধিসম্মত সতর্কীকরণ:‌ এটা মোটেই দিলীপ ঘোষের লেখা নয়। কোনও সাক্ষাৎকারে তিনি এমনটা বলেনওনি। নিছকই মন কী বাত। মুখ বন্ধ থাকলে মন একটু বেশি কথা বলে। হয়ত মনে মনে তিনি এমনটাই বলছেন।)‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *