শারদ যাপন
অন্তরা চৌধুরি
(ভাগলপুর থেকে)
সবাই বলে পুজো আসছে আসছেই ভাল। পুজো এসে গেলে কোথা দিয়ে যে তিন চার দিন কেটে যায় বোঝাই যায় না। বোঝার আগেই পুজো শেষ হয়ে যায়। কাজেই দুর্গাপুজোর আগে শারদ যাপন বা পুজো প্রস্তুতির মজাই আলাদা। নতুন জামা কাপড় নতুন জুতা কেনা তো আছেই। কিন্তু তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক আরও অনেক কিছু আছে। যাদের বাড়িতে পুজো হয় তাদের তো আরও বেশি মজা। দুর্গা পুজো বলে কথা। তার প্রস্তুতিও আলাদা রকম হবে সেটাই স্বাভাবিক।
এই যেমন আমাদের বাড়িতে মূর্তিপূজা না হলেও সব নিয়মকানুন মেনে ঘটেই পুজো হয়। কিন্তু সে এক হই হই ব্যাপার। মহালয়ার আগে থেকেই মা কাকিমার ব্যস্ততা তুঙ্গে। ঘর ঝাড়া দিয়ে পুজো প্রস্তুতি শুরু হয়। নাওয়া খাওয়ার সময় তাদের থাকে না। ছেলেমেয়েগুলো যে বাইরে আছে, তাদের ফোন করারও ফুরসৎ হয় না। কারণ তারা প্রচন্ড ব্যস্ত। ঘর ঝাড়ার পরের পর্ব হচ্ছে রান্নাঘরের কোটো-বাটা ধোয়া। ঠাকুর পরিষ্কার করা, তাদের জন্য নতুন কাপড় পাতা। মা দুর্গা আসছে বলে কথা। কোথাও যেন কোনও নোংরার নাম গন্ধ না থাকে। আগে আমাদের বাড়িতে অনেক লোকজন ছিল, তারা সবাই মিলে দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি নিত। যেমন ঠাকুমা, বড়জেঠু, ফুলকাকা, ছোটকা, বাবাই। কিন্তু কালের নিয়মে এখন তাদের স্মরণ করা হয় মহালয়ার দিন তর্পনের মাধ্যমে। আমাদের জমিদার বাড়ি না হলেও রক্তে মিশে আছে ষোলআনা বনেদীয়ানা। তাই পুজো আসার আগে ঠাকুরের সমস্ত কাঁসা, পিতলের বাসন বার করে ধোয়ামোছা হয়। বড় বড় লোহার কড়াই ঝাঁঝরা বার করা হয় অন্ধ কুঠির থেকে। কারণ মা দুর্গার মহাঅষ্টমীর ভোগের জন্য মিঠাই হবে।
দশকর্মার বাজার থেকে শুরু করে মা দুর্গার অন্ন ভোগের জন্য বাজার করা- সব মিলিয়ে সে এক অনন্য শারদ যাপন। বাবাই ছোটকা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন সবকিছু বাবাই করত, ছোটকা পুজোর জোগাড় করত। বাবাই এর যখন একটু একটু করে শরীরটা খারাপ হতে শুরু করল, তখন থেকে দুর্গাপুজো কালীপুজোর বাজার করার সমস্ত দায়িত্ব আমার ওপর এসে পড়ল। আমিও অপটু হাতে একটু একটু করে শিখতে লাগলাম নিপুনভাবে ফর্দ মিলিয়ে বাজার করা, ঠাকুর সাজানো। দুর্গা পুজোর সমস্ত কাজ একটু একটু করে শিখে ফেললাম। সে এক আলাদা আনন্দ আলাদা উত্তেজনা।
ঠাকুরের কাজ সারা হলে শুরু হতো আমাদের ঘরোয়া রূপচর্চার কাজ। আমি মা আর কাকিমা ঘরোয়া জিনিস দিয়ে ফেসিয়াল থেকে শুরু করে চুলে হেনা করা সবই করতাম। পার্লারে গিয়ে লাইন দিয়ে আই ব্রো করানো এটাও দুর্গাপুজোর অঙ্গ। কাকিমা হাতের কাছে যা পেতো পচা কুমড়ো পাকা শসা পচা পেঁপে সবই মোটামুটি মুখে মেখে নিতো। কারণ পুজোর আগে যে কোনও উপায়ে একটু চকচকে হতেই হবে। আমি খুঁজে পাই না পুজোর আগে সকলের এত সাজার হিড়িক কেন। তারপর ঘরোয়া ফেসিয়ালে সন্তুষ্ট না হয়ে পার্লারে লাইন দিয়ে একটু ফেসিয়াল মেসেজ কাকিমা করাবেই। তারপর বাড়িতে এসে বারবার আয়নাতে মুখ দেখবে। কিন্তু যতই ফেসিয়াল করানো হোক না কেন, প্রতিবছর কাকিমার একটাই আক্ষেপ- ‘ধুর! যে কে সেই। কোনও লাভ নেই ফেসিয়াল করিয়ে।’
বিয়ের পর যখন কলকাতা চলে এলাম, তখন আমি আর আমার কর্তা ভোরবেলায় উঠে হাঁটতে হাঁটতে প্যান্ডেল দেখতে যেতাম। ভোরবেলাতেই মাতৃদর্শন হয়ে যেত। তারপর ফিরে এসে চালিয়ে দিতাম আগমনী গান- ‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী উমা বড় দুঃখে রয়েছে’রয়েছে’। গানটা বড় ভাল লাগত। উমার দুঃখ যেন চোখের সামনে ফুটে উঠত। এক মায়ের তার আত্মজার জন্য যে আকুল বেদনা, সেটাও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতাম। একটু একটু করে বদলে যাওয়া প্রকৃতির রং, বদলে যাওয়া আকাশের রং, আর বদলে যাওয়া রোদের গন্ধ উপভোগ করতাম। অনুভব করতাম আকাশ বাতাস জুড়ে মায়ের আগমন। চা খেতে খেতে শুনতাম ‘শিশিরে শিশিরে শারদ আকাশে মায়ের আগমনী’। সব মিলিয়ে দুর্গা পুজোর আগের এই দিনগুলো বড় আনন্দে কাটত। কোনও দিন ভোরে উঠে চলে যেতাম শোভাবাজার রাজবাড়ি, কুমোরটুলি, পুরনো কলকাতার আনাচে-কানাচে। বাড়িতে পুজো বলে কোনওবারই কলকাতার পুজো দেখা হয় না। তাই বাড়ি যাওয়ার আগে যেটুকু সময় পেতাম, কর্তার সঙ্গে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতাম।
আমার কাছে পুজো মানে শুধু সেজেগুজে ঘুরে বেড়ানো নয়। আমার কাছে পুজো মানে মায়ের কাছে বসে থাকা, মায়ের পুজোর জোগাড় করা, ঘর ভর্তি আলপনা দেওয়া, আম পল্লব টাঙ্গানো, দরজায় দরজায় সিঁদুর দেওয়া, মায়ের সঙ্গে কথা বলা, মাকে সাজানো, মাকে খাওয়ানো, মায়ের জন্য ভোগ রান্না করা- এর এক আলাদা আনন্দ। আলাদা অনুভূতি। যাদের কাছে পুজো মানে শুধুই সেজেগুজে ঘুরে বেড়ানো, রেস্টুরেন্টে খাওয়া তারা এই অনুভূতিটা বুঝবে না। তাদের সেই আনন্দ আমি উপভোগ করতে পারব না। আর আমার এই আনন্দ তারাও বুঝতে পারবে না। আমার এই আনন্দ আমার ঐশ্বর্য।
পুজোর সময় ঘর ছেড়ে দূরে থাকার যে কী যন্ত্রণা তা এতদিন বুঝিনি। এখন প্রবাসী বাঙালি হয়ে বুঝতে পারছি। মন টানছে। বাড়ি টানছে। বাড়ির দুর্গা মা টানছে।
