অন্তরা চৌধুরি
বড্ড অহঙ্কার কাঞ্চনজঙ্ঘার! সেই বলে না যে অহঙ্কারে যেন একেবারে মাটিতে পা পড়ছে না। কাঞ্চনজঙ্ঘার ব্যাপারটাও ঠিক সেই রকম। যেহেতু সারা বছর তাকে দেখতে লক্ষ লক্ষ লোক পাহাড়ে যাচ্ছে, তাই তার এত দেমাক। ইচ্ছে হলে উনি দেখা দেবেন। না হলে মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়ে বসে থাকবেন। এদিকে যাঁরা এত হাজার হাজার টাকা খরচা করে পাহাড়ে গেলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে না পেয়ে তাঁরা হতাশ হয়ে মনের দুঃখে ফিরে আসছেন।
পাহাড়ে যাঁরা বেড়াতে যান তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি কমন প্রশ্নের মধ্যে একটি হল, ‘আপনারা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেয়েছেন?’ লক্ষ করে দেখেছি ‘হ্যাঁ’ বললে উল্টোদিকের ব্যক্তি দুঃখ পায়। আর ‘না’ বললে অদ্ভুত আনন্দ পায়। আর ঠিক এই সুযোগটাই কাজে লাগায় আমাদের কাঞ্চনজঙ্ঘা। শীতকালে যদিও তাঁর দেখে মেলে, গরমকাল বা বর্ষাকালে তো কথাই নেই। সারাক্ষণ মেঘ আর বৃষ্টি। একসময় বৃষ্টি বন্ধ হয়ে ঝকঝকে রোদও ওঠে। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখার কোনও আশা নেই। আচ্ছা সব মানুষ কি শীতকালে বেড়াতে যেতে পারে! সেই সময় ছুটিছাটা কোথায়! গরমকালেই তো ঠান্ডার জায়গায় যাওয়ার মজা। তীব্র গরমে সমতলবাসীর যখন নাজেহাল অবস্থা, তখন পাহাড়বাসী দিব্বি গায়ে সোয়েটার, জ্যাকেট, টুপি, মোজা চাপিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আগে খুব ভাল লাগত। যতবারই পাহাড়ে গিয়েছি পাঁচদিন, ছ’দিন ধরে তার দর্শন পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি। হয়তো ঠিক ফেরার দিন অতিরিক্ত কৃপণের মতো সবাইকে একটু ‘গুডমর্নিং’ জানিয়ে আবার মুখ লুকিয়ে ফেলল। এই সব অসভ্যতাগুলো অনেক বছর ধরে সহ্য করেছি। কিন্তু আর নয়। তাই এবারে আমিও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও পাহাড়ে আরও অনেক কিছু দেখার আছে। উপভোগ করার আছে। তাই তাকে দেখা গেল বা না গেল সেই নিয়ে হাপিত্যেশ করিনি। সবাই আসলে এই কাঞ্চনজঙ্ঘাকে অতিরিক্ত প্রায়োরিটি দিয়ে দিয়েছে। এতটা গুরুত্বও আবার সে ডিসার্ভ করে না।
পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া অধিকাংশ মানুষের মধ্যে একটা আদিখ্যেতা লক্ষ করেছি। হোমস্টে হোক বা হোটেল, বুকিং করার সময় আগেই একটা প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা এই সময় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাবে?’ যেন ওই একটা শখের পাহাড় দেখা ছাড়া আর কিছু দেখার নেই।
আর যখনই কেউ কারও দুর্বল জায়গাটা জানতে পারে, তখন সেই পয়েন্টেই বেশি করে আঘাত দেয়। সে মানুষই হোক বা পাহাড়। পাহাড়ে বেড়াতে আসা সব মানুষের ফ্যান্টাসি হোক বা সফট কর্নার, সেটা কাঞ্চনজঙ্ঘা। আর সেই কারণেই নিজেকে লুকিয়ে রেখে দর্শনার্থীদের মনে আঘাত দিয়ে এক ধরণের বিকৃত আনন্দ পায় এই কাঞ্চনজঙ্ঘা। কিন্তু তার কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে। ভক্তই যদি না থাকে, তাহলে ভগবানের পুজো হবে কেমন করে? রূপের ওই প্রদীপ জ্বেলে কী হবে তোমার যদি কেউ না থাকে দেখার!
তবে হ্যাঁ। মন ভরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে ছিলাম ঝান্ডি থেকে। সেবারে আমি আর আমার কর্তা বেড়াতে গিয়েছিলাম ঝান্ডি। সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। অস্বাভাবিক ঠান্ডার চোটে তিন–চারখানা ব্ল্যাঙ্কেট নিয়েও শীত কাটছে না। ঘুমও আসছে না। কী মনে হল বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। মনে মনে ভাবলাম পূর্ণিমা রাতের এই মায়াবি জ্যোৎস্নায় হিমালয়ের নিস্তব্ধতা অনুভব করব। দরজা খুলে চোখটা একটু ধাতস্থ হতেই দেখি সামনেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। চাঁদের রুপোলি আলো পড়ে বরফের চূড়াগুলো ঝকঝক করছে। কী অপরূপ তার সেই রূপ! মনে হচ্ছিল যেন কী অপার বিস্ময় লুকিয়ে আছে ওই পাহাড়ে। কর্তাকে ঘুম থেকে তুললাম। সে-ও সাক্ষী রইল ওই মাহেন্দ্রক্ষণের। সেই মুহূর্তে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ ও রঙ প্রকাশ করার কোনও ভাষা নেই। মনে হয়েছিল এমন পাহাড়েরই তো অহঙ্কার করা সাজে। অহঙ্কার করতে গেলে যোগ্যতা লাগে। আর এই পাহাড়ের সেটা আছে বলেই সে নিজের আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। নিজেকে সহজলভ্য করে ফেলেনি বলেই তো আদি অনন্তকাল ধরে মানুষ হিমালয়ে ছুটে যায়। ছুটে যায় তাকে একটিবার দেখার আশায়। মানুষের ভালবাসার এমন মণিহার তো তারই সাজে।
