‌কেষ্টবাবুর প্রতিভা কেউ বুঝলই না

স্বরূপ গোস্বামী

কেন জানি না, আপনাকে আমার বেশ লাগে। বরাবরই বেশ একটা অন্যরকম। আর দশজনের থেকে আলাদা। একেবারেই আলাদা। সবাই আপনার কত নিন্দে–‌মন্দ করে। আমার বাপু তাতে মন সায় দেয় না। আসলে, আপনার প্রতিভা লোকজন ঠিক বুঝতে পারে না। তাই গালমন্দ করেই আনন্দ পায়। আবার কয়েক মাস যেতে না যেতে লোকে সেগুলো ভুলেও যায়। দেখতে দেখতে আবার একটা পুজো এসে গেল। চড়াম চড়াম ঢাক বাজানো লোকটা কেমন আড়ালে চলে গেল।

এই তো মাস কয়েক আগে, আপনার একটা অডিওটা ভাইরাল হল, সেই কদিন আপনার নিন্দেয় কান পাতা দায়। টিভিতে আবার স্বমহিমায় আপনি। আইপিএল চলছে?‌ চলুক গে। সীমান্ত সঙ্ঘর্ষ নিয়ে এখনও চাপান উতোর!‌ ধুর, ওগুলো আবার কোনও খবর নাকি!‌ মনে হচ্ছিল, আমাদের কেষ্ট মণ্ডল আছে। খবর দেখে না। খবর তৈরি করে। আর তা নিয়েই দিনভর মেতে থাকে আমাদের মিডিয়া।

আপনি কোন পুলিশের মা–‌বউ তুলে কী গালাগাল দিয়েছেন, তা নিয়ে লোকের কৌতূহলের শেষ নেই। লোকে বলছিল, অশ্রাব্য ভাষায় নাকি কী সব বলেছেন। কিন্তু সেই ‘‌অশ্রাব্য’‌ শব্দগুলো শোনার কী পুলক!‌ চ্যানেলে ‘‌বিপ’‌ চলেছে। লোকে কিন্তু ‘‌র’‌ অডিওটাই খুঁজেছে। আপনার ডিমান্ডই আলাদা। শুনব না, শুনব না করে সব বাঙালি ঠিক শুনে ফেলল। বাঙালি আসলে এগুলোই শুনতে চায়। আজকের বাঙালি এগুলো শোনারই যোগ্য। এই গালাগাল গুলো আমরা অনেকেই দিয়ে থাকি। কিন্তু আপনার কণ্ঠে এগুলো যেন নতুন করে প্রাণ পায়।

আসলে, কেউ আপনাকে বুঝতেই চায় না। আপনি একটা কথা বলতে গিয়ে কত না বলা কথা বলে ফেলেন। একটা বার্তা দিতে গিয়ে কতরকম বার্তা দিয়ে যান। এ যেন যত মত, তত পথ। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। আপনি নাকি থানার আইসি–‌কে কী সব গালাগাল দিয়েছেন। যেমন তেমন থানা নয়, একেবারে বোলপুর। রাবীন্দ্রিক ছোঁয়ায় মোড়া থানা। আইসি–‌কে আপনি গালাগাল দেবেন, এ আর নতুন কথা কী?‌ আরেকটা ফোনে আপনি ধরেছিলেন রাজীব কুমারকে। তিনি আবার মামুলি আইসি, টাইসি নন। একেবারে রাজ্য পুলিশের ডিজি বলে কথা। তাঁকেও কী সুন্দর সম্ভাষণ!‌ কী নিষ্পাপ এক আবদার। এই —— ছেলেটাকে সরাবে না?‌ এমন বিনয় নিয়ে কতদিন কাউকে কথা বলতে শুনিনি। আপনি বুঝিয়ে দিলেন, এমন আইজি–‌কে আপনি আসলে কঁড়চে গোঁজেন। এমন আইজিকে আপনি চাকর–‌বাকরের বেশি কিছু ভাবেন না। তাঁকেও আপনি খিস্তি দিয়েই কথা বলতে পারেন। এই বাংলায় কজনের এমন বুকের পাটা আছে!‌ আপনি রাজীব কুমারকে বললেন, দেখো না, ওকে আমি এমন মারব!‌ অর্থাৎ, ডিজিকে বলছেন, তাঁর অধস্তন আইসি–‌কে আপনি মারবেন। এরপরেও ডিজি যে কিছুই করতে পারবেন না। জাস্ট দাঁত ক্যালাবেন। এটাই আপনি বুঝিয়ে দিলেন। অথচ, লোকে এটা বুঝতেই চাইল না!‌ লোকে বলে, আপনার মাথায় নাকি অক্সিজেন কম যায়। এখন দেখছি, টিভিতে বসা ওই বুদ্ধিজীবীগুলোর মাথায় অক্সিজেন আরও কম যায়।

আপনাকে ডেকে পাঠাবে!‌ কার এত হীম্মৎ?‌ বেচারা যে আইসি–‌কে ফোন করেছিলেন, তাঁর ফোনটাই বাজেয়াপ্ত হল। আপনি না হয় গালাগাল দিয়েছেন, সে ব্যাটা কেন ছড়িয়ে দিল!‌ এত সাহস!‌ অনেক জলঘোলার পর আপনাকে নম নম করে ডাকা হল। হ্যাঁ, নম নম করেই বটে। আপনাকে জেরা করার জন্য থোড়াই ডাকা হয়েছে!‌ হুজুর মাই বাপ, আপনার ওই অডিও ফাঁস করা খুব অন্যায় হয়েছে, এটা বলার জন্যই তো ডাকা হয়েছিল। আপনি গেলেন বীরদর্পে, বেরিয়ে এলেন বীরদর্পে। আপনার সাক্ষাৎ পেয়ে ওঁরাই যেন ধন্য হল।

বলা হচ্ছে, আপনার মাথায় নাকি মুখ্যমন্ত্রী না কার একটা আশীর্বাদের হাত আছে। যারা এমনটা বলে, তারা আসলে কিছুই বোঝে না। গত চোদ্দ বছরে মুখ্যমন্ত্রীকে এমন অপদস্থ আর কজন করেছেন!‌ নেহাত মুখ্যমন্ত্রী বোঝেন না, তাই। বুঝলেই বা কী করবেন!‌ কিচ্ছু করতে পারবেন না। মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, তিনি নাকি দারুণ উন্নয়ন করেছেন। সেই কারণেই জেতেন। শাসকদলের সবাই এই বুলি আউড়ে যান। একমাত্র আপনি ব্যতিক্রম। আপনিই বোঝেন, মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়ন আসলে ঘোড়ার ডিম। ওইসব বলে জেতা যাবে না। আপনার লেঠেল বাহিনী চাই, আপনার পাঁচন চাই, আপনার গুড়বাতাসা চাই। মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়নকে এতখানি চ্যালেঞ্জ আর কেউ জানাতে পেরেছেন?‌ আপনিই একমাত্র লোক, যিনি ‘‌উন্নয়ন’‌কে রাস্তায় নগ্ন করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। উন্নয়ন যে স্রেফ একটা বাতেলা, তা এত স্পষ্ট করে আর কে বোঝাতে পেরেছে!‌ এরপরেও লোকে বলে আপনি কিনা মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্য!‌

আপনি সত্যিই প্রভাবশালী। আপনাকে নিয়ে যাওয়া হল তিহারে। দু’‌বছর পর বেরিয়ে এলেন বীরদর্পে। সিবিআই না কী যেন একটা কাঁচকলা এজেন্সি আছে, আপনি তাদের যথার্থই কাঁচকলা দেখিয়ে দিলেন। আপনার নামে নাকি গরু, বালি, কয়লা পাচারের অভিযোগ। এত ভুরি ভুরি অভিযোগ, এত প্রমাণের ছড়াছড়ি। তারপরেও সিবিআই চার্জশিটে প্রায় কিছুই তুলে ধরতে পারল না। আপনি কী অবলীলায় জামিন পেয়ে গেলেন। সিবিআই যে আসলে কতটা অপদার্থ, আপনি আপনার মতো করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এরপরেও কেন যে লোকে সিবিআই তদন্ত চায়!‌

আচ্ছা, আপনি কেন জামিন পেলেন?‌ এই কারণটা অনেকেই জানে না। আপনার বাংলায় দেওয়া বয়ান নাকি ইংরাজিতে অনুবাদ করার লোক ছিল না?‌ কী এমন বাংলা বলেছেন মশাই!‌ শতাধিক বছর আগে গীতাঞ্জলি অনুবাদ হয়ে গেল। সেই অনুবাদ নোবেল পেয়ে গেল। অথচ, আপনার লেখা তার একশো বছর পরেও কিনা অনুবাদ করাই গেল না। সত্যিই, আপনার জবাব নেই। বাংলা ভাষাকে আপনি অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। অথচ, এমন প্রতিভার কথা কোথাও আলোচনাই হচ্ছে না!‌ রাগ করবেন না কেষ্টদা। বাঙালি কোনওকালেই গুণীর কদর করতে শেখেনি। সে শুধু কুৎসা ছড়াতেই শিখেছে।

লোকে বলে, আপনার সঙ্গে নাকি পুলিশ আছে। রাজ্য প্রশাসন আছে। এমন বলছে, যেন গবেষণা করে বিরাট কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে। আরে বাবা, রাজ্য পুলিশ তো আর কয়লা, গরুর তদন্ত করে না। এগুলো চালায় কেন্দ্রীয় সরকার। ওই মোদি আর অমিত শাহ না কী যেন নাম!‌ তাঁরা মাঝে মাঝে এসে হুঙ্কার ছাড়েন, কয়লা, গরু পাচারকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। অনেকে হয়তো ভয় পায়। আপনার ভয় ডর বলে কিছুই নেই। আপনি জানেন, এগুলো সব ফাঁকা আওয়াজ। আপনি জানেন, সিবিআই–‌ইডি আপনার কাঁচকলা করবে। আপনি জানেন, লাভের বখরা কোথায় কোথায় যায়। আপনি জানেন, আপনাকে ছুঁতে গেলে, অনেকের গায়েই সেই ছ্যাঁকা লেগে যাবে। অতএব, তাঁদেরই দায়িত্ব আপনাকে রক্ষা করা। তাঁদেরই দায়িত্ব আপনার বিরুদ্ধে কেস হালকা করে দেওয়া। তাঁদেরই দায়িত্ব আপনার জামিনের বন্দোবস্ত করা। তাঁদেরই দায়িত্ব আপনাকে ‘‌বীরের সম্মান’‌ দিয়ে জেলায় ফেরানো। তাঁদেরই দায়িত্ব আপনার খিস্তি দাঁতকেলিয়ে হজম করে ধন্য হওয়া।

অতএব, কেষ্টবাবু, আপনি যা করেছেন বেশ করেছেন। এমন পুলিশের এমনটাই প্রাপ্য। সিবিআই যদি আতা ক্যালানে হয়, তবে সেই সিবিআইকে যারা চালায়, তাদেরও এমনটাই প্রাপ্য। লোকে ভাবল, আপনি বোধ হয় নারীদের ধর্ষণের হুমকি দিয়েছেন। ধুর, এই আহাম্মকগুলো কিছুই বোঝে না। মা, বউ এগুলো নেহাতই প্রতীকী। আসলে, আপনি, পুলিশ, প্রশাসন, সিবিআই, রাজ্য, কেন্দ্র— সবাইকেই যা করার করে দিয়েছেন।

তাই, আপনাকে ভাল না বেসে পারা যায় না। তাতে আমাকে যে যা গালাগাল দেয়, দিক। আপনার এই সাহসিকতা দীর্ঘজীবী হোক। যাঁরা রাজ্য চালান, যাঁরা দেশ চালান, আপনার কাছে সবাইকেই বড় কাপুরুষ মনে হয়। এভাবেই সবাইকে নগ্ন করুন। এভাবেই সবাইকে ধর্ষণ করুন। ধর্ষিত হওয়াই এঁদের ভবিতব্য।‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *