অজয় নন্দী
প্রথম খেলা লেকের মাঠে প্রথম ফুটবল
মান্না, পিকে, চুনীর ছবি বিরাট সম্বল।
কলকাতা ফুটবলের তিন কিংবদন্তির আত্মজীবনী লেখা হয়েছিল। শৈলেন মান্নার আত্মজীবনীর নাম মনে নেই। পিকের আত্মজীবনী ‘উইং থেকে গোল’। আর চুনীর আত্মজীবনী, ‘খেলতে খেলতে’। যতদূর মনে পড়ে, তিনটিই প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দমেলায়, ধারাবাহিকভাবে। লিখেছিলেন একজনই, অশোক দাশগুপ্ত।
তারপর এল খেলা পত্রিকা। পুজো সংখ্যায় প্রতি বছরই কারও না কারও আত্মজীবনী। এমনকী সাপ্তাহিক খেলায় ধারাবাহিকভাবেও বেরিয়েছে তুলসীদাস বলরামের আত্মজীবনী। কিন্তু নয়ের দশক থেকেই যেন কিছুটা ভাটা পড়ল। ফুটবলাররা আর আত্মজীবনী লিখতে সেভাবে এগিয়ে এলেন না। সত্যিই কি তাঁরা লিখতে চাইতেন না? নাকি প্রকাশক পাওয়া যেত না? নাকি গুছিয়ে লিখবেন, এমন অনুলেখক পাওয়া যেত না?
গত চার–পাঁচ বছরে ছবিটা অনেকটাই বদলেছে। এগিয়ে এল দীপ প্রকাশন। প্রতি বছরই কারও না কারও আত্মজীবনী। শুরু হয়েছিল পিকে ব্যানার্জিকে দিয়ে। তারপর সুভাষ ভৌমিক। তারপর সুব্রত ভট্টাচার্য। এবার প্রশান্ত ব্যানার্জি। চারটিই বাজারে আনল দীপ প্রকাশন। চারটির ক্ষেত্রেই অনুলেখক সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়। আনন্দবাজারের তিন দশকের অভিজ্ঞ সাংবাদিক সুপ্রিয় এতদিন কাজটা করতেন আড়াল থেকে। ফলে সেভাবে পাদপ্রদীপের আলোয় এসে পড়েননি। এই চারটি জীবনী যেন তাঁর কেরিয়ারে অন্য একটা মাত্রা এনে দিল। টুকটাক তথ্যগত ভুল হয়তো আছে, কিন্তু যে মুন্সিয়ানার সঙ্গে তিনি বিষয় বিন্যাস করেছেন, হারিয়ে যাওয়া ঘটনাগুলোকে তুলে ধরেছেন, তা সত্যিই তারিফযোগ্য।
সুভাষ ভৌমিক বা সুব্রত ভট্টাচার্যর ক্ষেত্রে বিতর্ক থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। হয়তো ‘বিস্ফোরক’ তকমা দেওয়াই যায়। কিন্তু প্রশান্ত ব্যানার্জির খেলোয়াড়জীবনের ভাবমূর্তি একেবারেই অন্যরকম। ঠান্ডা মাথার পরিচ্ছন্ন ফুটবলের মতোই মাঠের বাইরেও বিতর্ক থেকে যতটা সম্ভব দূরেই থাকতেন। তাঁর জীবনে বিতর্কের বিরাট কোনও উপাদান নেই। সবার সঙ্গেই সদ্ভাব রাখতেন। কারও সঙ্গে গায়ে গা পেড়ে ঝগড়া করতেন না। আত্মজীবনীতেও সেই প্রশান্তকেই তুলে ধরেছেন অনুলেখক সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়। কারও প্রতি কৃতজ্ঞতায় কার্পণ্য রাখেননি। উৎসর্গ করেছেন ছোটবেলার কোচ প্রয়াত বাবু গুহকে। এর থেকেই বোঝা যায়, তিনি আর যাই হোক, অকৃতজ্ঞ নন। সুভাষ ভৌমিক, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, গৌতম সরকারদের প্রতি ঝরড়ে পড়েছে অগাধ শ্রদ্ধা। দুই কোচ পিকে ব্যানার্জি, অমল দত্তর মূল্যায়ন যেমন আছে, তেমনই জাতীয় কোচ চিরিচ মিলোভানের জন্য ব্যয় করেছেন আস্ত একটা চ্যাপ্টার। তিনি অন্তত কর্তাদের শ্রেণিশত্রু মনে করেননি। তিন কর্তাদের সম্পর্কে বেশ শ্রদ্ধাশীল, সেটা বারেবারেই ধরা পড়েছে।
সবমিলিয়ে এই আত্মজীবনী সাতের দশক ও আটের দশকের কলকাতার ফুটবলের আবহকে অনেকটাই চিনিয়ে দেবে। একজনের জীবনী মানে তো শুধু তাঁর কথা নয়। তাঁর সমকাল, তাঁর সতীর্থ, তাঁর চারপাশে থাকা নানা চরিত্রকেও চিনিয়ে দেয়। সেখানেই এই বইয়ের সার্থকতা। অহেতুক চাঞ্চল্য তৈরির ঝোঁক নেই। প্রশান্তর খেলোয়াড় জীবনের মতোই মসৃণ গতিতে এগিয়েছে। এমনিতেই ফুটবলের প্রতি নেট দুনিয়া ততটা সচল নয়। পুরনো কোনও তথ্য বা ঘটনা যাচাই করার চটজলদি উপায়ও নেই। যেসব বইয়ে আছে, সেগুলিও বেশ দুষ্প্রাপ্য। এরকম আরও বই লেখা দরকার। যাতে বাংলার ফুটবলের ইতিহাস ও উন্মাদনা ধরা থাকবে। নানা ঘটনা, নানা ব্যাখ্যাও থাকবে। অনেক কিছু জানা গেল। আরও জানার খিদেকে উস্কেও দিল এই বই।
মাঝমাঠের রাজপাট
প্রশান্ত ব্যানার্জি
সহ লেখক সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
দীপ প্রকাশন
