আড়াল থেকে চিরআড়ালে

অজয় নন্দী

বিশ্বকাপ ফুটবল বা বিশ্বকাপ ক্রিকেট। সাধারণত দেখা যায়, কোনও কাগজ বা চ্যানেলের ক্রীড়া সম্পাদকরা যাচ্ছেন কভার করতে। তাঁরা ম্যাচরিপোর্ট করেন, তারকাদের কথা লেখেন, শিবিরের গোপন খবর লেখেন, সেই শহরের কথা লেখেন। পরের দিন কাগজে আমরা সেটাই পড়ি।

কিন্তু কেউ কেউ থাকেন, একেবারেই ব্যতিক্রম। তাঁরা কোনও বিশ্বকাপ কভার করতে যান না। তাঁরা ম্যাচরিপোর্ট লেখেন না। বলা যায়, একেবারে আড়ালে থেকে কাজ করেন। খেলার পাতাটা যেন আরও সুন্দর ও বুদ্ধিদীপ্ত হয়, সেই জন্য সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত লড়ে যান। তাঁদের কথা আমরা জানতেও পারি না। তেমনই একজন মানুষ ছিলেন ধীমান দত্ত। আজকাল সংবাদপত্রের ৩৩ বছরের ক্রীড়া সম্পাদক। নিঃশব্দেই চলে গেলেন।

সাতের দশকের শেষবেলা। তিনি তখন প্রেসিডেন্সির স্ট্যাটিস্টিক্সের ছাত্র। অত্যন্ত মেধাবী। চাইলে, অধ্যাপক হতে পারতেন। যে কোনও পেশাতেই সফল হতে পারতেন। কিন্তু বেছে নিলেন সাংবাদিকতার জগৎকে। বাড়িতে অবশ্য সাংবাদিকতার একটা আবহ ছিলই। বাবা মুকুল দত্ত। আনন্দবাজারের ক্রীড়া সম্পাদক। ছোট থেকেই দেখেছন, বাবা কীভাবে খেলার পাতাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলছেন।

ধীমান দত্তর কাজ শুরু হল ‘‌খেলার কাগজ’ থেকে। পরের বছরই জন্ম নিল ‘‌আজকাল’‌। সম্পাদক গোরকিশোর ঘোষ। ক্রীড়া সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত। একটা লড়াকু ব্রিগেড তৈরি করলেন অশোক দাশগুপ্ত। যে টিমে ছিলেন দেবাশিস দত্ত, সরোজ চক্রবর্তী, ধীমান দত্ত, নির্মলকুমার সাহা, পল্লব বসুমল্লিক, রতন ভট্টাচার্যর মতো সাংবাদিকরা। সবথেকে বড় সাফল্য ছিল কলকাতা ময়দানের গড়াপেটাকে সামনে আনা। দলবদলকে ঘিরে একের পর এক গোপন ও চাঞ্চল্যকর খবর। পাঠকের মনে দ্রুত সাড়া ফেলল আজকালের খেলার পাতা।

একটা সময় এল, যখন অশোক দাশগুপ্ত কাগজের সম্পাদক হয়ে গেলেন। ক্রীড়া সম্পাদকের ব্যাটনটা তুলে দিলেন ধীমান দত্তর হাতে। ১৯৮৬তে সেই শুরু। কেটে গেল ৩৩ বছর। চাইলে তিনি পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ঘুরে বেড়াতে পারতেন। কিন্তু কোথাও গেলেন না। অন্য সহকর্মীদের পাঠিয়ে গেলেন। দুরন্ত লেখনি ছিল। কিন্তু নিজের নামে লেখা প্রায় ছেড়েই দিলেন। তুলে আনলেন অন্য সহকর্মীদের। ফুটবল, ক্রিকেট তো গ্ল্যামারের বৃত্তে ছিলই। হকি, অ্যাথলেটিক্স, টেবিল টেনিস, সাঁতার, কবাডি, দাবা— এই সমস্ত খেলাকেও তুলে আনলেন উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে।

সাত সকালেই সব কাগজ পড়া হয়ে যেত। সকাল থেকেই ফোনে সহকর্মীদের নানা নির্দেশ দেওয়ার কাজ শুরু। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মনিটারিং। অন্য কাগজের দিন শুরু হত সন্ধেবেলায়। বিকেলের আগেই তিনি প্রায় আশিভাগ কাজ গুটিয়ে এনেছেন। কোন ঘটনাকে কতরকম দষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, কী ব্যতিক্রমী অ্যাঙ্গেল তুলে আনা যায়, সারাদিন ধরেই চলত গবেষণা। কখনও খবরে, কখনও বিশ্লেষণে, কখনও জ্বালাময়ী লেখায়, আবার কখনও দুরন্ত লে আউটে। এমন এমন বিষয় উঠে আসত, যা সাধারণ পাঠকের ভাবনার বাইরে!‌ মনে হত, এভাবেও ভাবা যায়!‌ পরের দিন আজকাল যেন পৌঁছে যেত অন্য এক উচ্চতায়।

‌শুরু থেকেই আজকালের একটা চরিত্র, খেলোয়াড়দের পাশে থাকা। সেই অবস্থানে অনঢ় থেকেছেন। জানতেন, কাকে দিয়ে কোন কাজটা হবে। হকির ওই অ্যাসাইনমেন্টটা কাকে দেওয়া যায়, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এই ম্যাচটা কে করবে, মোহনবাগান–‌ইস্টবেঙ্গল দুই কোচের ইন্টারভিউ কারা করবেন, এশিয়ান গেমসে কাকে পাঠানো যায়, ডেস্কে কার কী দায়িত্ব থাকবে, অমুক বিশেষজ্ঞর লেখাটা কে লিখবেন। একজন সেনাপতি শুধু নিজে যুদ্ধ করেন না, কোথায় কোন সৈন্য মোতায়েন করতে হবে, সেটাও জানেন। তেমনই একজন সেনাপতি ছিলেন ধীমান দত্ত। গোটা টিমকে নিয়ে চলতেন। কিন্তু নিজে থাকতেন আড়ালে।

এখন আড়ালে থাকা মানুষের বড় অভাব। নিজেকে জাহির করার এই পৃথিবীতে ধীমান দত্ত যেন একেবারেই ভিন গ্রহের এক মানুষ। হয়তো তাই, আড়াল থেকে চলে গেলেন চিরআড়ালে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *