ক্রীড়া সাংবাদিক দিবসে একটু আয়নার সামনে দাঁড়ান ক্রীড়া সাংবাদিকরা

অজয় নন্দী

১ জুলাই দিনটা পালিত হয় চিকিৎসক দিবস হিসেবে। পরের দিনটা হল ক্রীড়া সাংবাদিক দিবস। বিভিন্ন ক্রীড়া সাংবাদিকেরা দিনটি নানাভাবে স্মরণ করেছেন। নিশ্চিতভাবেই নানারকম ছবি পোস্ট করেছেন। নিজেদের কীর্তির বীরগাথা রচনা করেছেন। নানা দিকপাল লোকের সঙ্গে ছবি পোস্ট করে অনেকে প্রমাণ করতে চাইবেন, তিনি কত বড় মাপের ক্রীড়া সাংবাদিক।

ক্রীড়া সাংবাদিকতার সেকাল–‌একাল নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। যাঁরা সেকালের সাংবাদিক, তাঁরা একালকে কী চোখে দেখেন, যাঁরা একালের সাংবাদিক, তাঁরা সেকালকেই বা কী চোখে দেখেন। এই নিয়ে নানা সভায় নানা গুরুগম্ভীর আলোচনা হয়েছে। আর এই ভার্চুয়াল মাধ্যমে তো সেই আলোচনা ঘরে ঘরে পৌঁছেও যাচ্ছে।

কিন্তু প্রশ্ন হল, এত কিছু শোনার বা জানার আগ্রহ আছে কি?

কয়েকটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রতিবার বইমেলায় খেলা সংক্রান্ত অন্তত কুড়ি খানা বই বেরোয়। এবারে সংখ্যাটা আরও বেশি। কজন ক্রীড়া সাংবাদিক সেইসব বই কেনেন?‌ কজন পড়েন?‌ গত পাঁচ বছরে পাঁচটা বই পড়েছেন, এমন ক্রীড়া সাংবাদিক সত্যিই দুর্লভ। হাতে গোনা।

সার্বিকভাবেই পড়ার অভ্যেসটা কমে যাচ্ছে। এতে প্রায় সবাই কম–‌বেশি আক্রান্ত। একজন আইটি সেক্টরের ছেলে বা একজন ম্যানেজমেন্ট পাস করা ছেলে পড়ল কিনা, তাতে খুব বেশি কিছু যায় আসে না। কিন্তু সাংবাদিকদের বড় একটা অংশ মনে করতে শুরু করেছেন, পড়াশোনার কোনও দরকার নেই। বই তো ছেড়ে দিন। এক পাতা কাগজ পড়ার লোকও বড্ড কমে আসছে।

অনেকে বলেন, রোজ এত কিছু পড়া সম্ভব নয়। কোনও কোনওদিন ব্যস্ততা থাকতেই পারে। হয়ত সেদিন পড়া হল না। কিন্তু মাসে একদিনও কি পড়া হয়?‌ জিজ্ঞেস করুন, খবরের কাগজে শেষ কবে দু’‌পাতা পড়েছেন?‌ কেউই স্বীকার করবেন না। গায়ের জোরে, গলার জোরে বলবেন, পড়ি তো। কিন্তু একটু কথা বললেই বোঝা যায়, বহুদিন খবরের কাগজের একটি পুরো পাতা পড়েননি। শুধু নামগুলো উল্টে পাল্টে দেখেছেন। কে কেন বাইলাইন পেল, কে কোন ট্যুরে যাচ্ছে, তা নিয়ে গুলতানি করেছেন। কিন্তু লেখাগুলো আর পড়া হয়ে ওঠেনি।

এই আবহেও গত কয়েক বছরে খেলার ওপর বেশ কিছু ভাল বই লেখা হয়েছে। চাইলে দীর্ঘ তালিকা পেশ করা যায়। গত তিন বছরে তিনটি অসাধারণ বই তুলে ধরলেন সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়। পিকে ব্যানার্জি, সুভাষ ভৌমিক ও সুব্রত ভট্টাচার্যকে নিয়ে। গৌতম ভট্টাচার্য, দেবাশিস দত্ত, রূপক সাহাদের কলম এখনও চলছে। ছড়িয়ে আছে অজস্র মণিমুক্তো। অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায় দেখতে দেখতে চারখানা বই লিখে ফেললেন। সবগুলোই খেলার ওপর। গ্ল্যামার বৃত্তের বাইরে থাকা খেলা ও খেলোয়াড়দের নিয়ে চিরকাল লিখে এসেছেন নির্মলকুমার সাহা। গত কয়েক বছরে একেবারে অন্য ঘরানার কয়েকটি বই লিখেছেন। কজন সাংবাদিক সেই বই পড়েছেন? বিশ্ব ফুটবলের ওপর কাশীনাথ ভট্টাচার্যও বেশ কয়েকটি বই লিখলেন। ক্রীড়া উপন্যাস লিখলেন সব্যসাচী সরকার, অভিষেক সেনগুপ্তরা। মুনাল চট্টোপাধ্যায়, সুস্মিতা গঙ্গোপাধ্যায় জুটিও এত বছরের অভিজ্ঞতার ঝুলি উজাড় করে দিয়েছেন। ময়দানের পরিচিত রিপোর্টার শিবাজি চক্রবর্তী। তাঁর দুটি বইই নানা অজানা গল্পে ঠাসা। বেশ সুখপাঠ্য। বেশ সাড়া ফেলেছে বোরিয়া মজুমদার, রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস। তাঁরা ময়দানের পরিচিত ও অভিজ্ঞ সাংবাদিক। নিজেদের অভিজ্ঞতার ঝুলি উজাড় করে দিয়েছেন। কজন সতীর্থ সেই বই পড়েছেন?‌ অথচ, ফেসবুকের দৌলতে জানেন না, এমনটাও বলা যাবে না। বেশ জানেন। হয়তো লাইক মেরেছেন, কমেন্ট করেছেন। আড়ালে আবডালে বাঁকা মন্তব্যও করেছেন। কিন্তু কেনার বা পড়ার তাগিদ অনুভব করেননি। গত দু বছরের বেশি সময় ধরে নবজন্ম হয়েছে খেলা পত্রিকার। অনেকেই এখান থেকে হাত পাকিয়েছেন। অনেকের বেড়ে ওঠার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই পত্রিকা। বেশ কয়েকটি সংখ্যা সত্যিই মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতো। প্রায় সব স্টলেই পাওয়াও যায়। কিন্তু কোনও একটা সংখ্যা দশ পাতা পড়েছেন, এমন ক্রীড়া সাংবাদিক বিরল। খেলা পুজো সংখ্যা। বেশ আকর্ষণীয়। কুড়ি পাতা পড়েছেন, এমন লোক কজন পাওয়া যাবে?

আসলে, এখানেও পড়ার অভ্যেসটাই চলে গেছে। সারাদিন মোবাইলে মগ্ন থেকে থেকে ভেবে ফেলেছেন, তাঁরা বোধ হয় দারুণ আপডেটেড। আসলে, ঠিক উল্টোটা। তাই চারদিন আগে বেরিয়ে যাওয়া কপিও দিব্যি ঢাউস বাইলাইন কপি হয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট টুকরোর মধ্যে লিড হওয়ার উপাদান আছে। কিন্তু দেখার চোখটা তো চাই। সবথেকে বড় কথা, ওই ছোট্ট টুকরোটা পড়লে তবে তো ফলোআপের ভাবনাটা আসবে। এভাবেই কত দারুণ স্টোরি হতে হতেও হয় না। স্রেফ না পড়ার কারণে।

মনোজ তেওয়ারি অবসর নিলে সেটাও ফেসবুক পোস্ট থেকে জানতে হয়। দুদিন ধরে তাঁকে ফোনেও ধরা যায় না। আবার তিনি অবসর ভেঙে ফিরে আসছেন, সেটাও জানতে হয় প্রেস কনফারেন্স থেকে। ঋদ্ধিমান সাহা বাংলায় ফিরে আসছেন, এটাও জানতে হয় ঋদ্ধিমানের স্ত্রীর ফেসবুক পোস্ট থেকে। আগে বাংলার সাংবাদিকরা বলে বলে জাতীয়, আন্তর্জাতিক এক্সক্লুসিভ করতেন। এখন ঋদ্ধিমান, মনোজদের খবরও ফেসবুক থেকে টুকতে হয়। কলকাতা ফুটবলেও এমন অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। যেখানে খবরের উৎস সেই ফেসবুক।

আগে যদিও বা মাঠে যাওয়ার রেওয়াজটা ছিল। এর তার সঙ্গে দেখা হত। তাতেও দু–‌চারটে খবরের হদিশ মিলত। করোনা এসে সবাইকে যেন আস্ত কুঁড়ে বানিয়ে দিয়েছে। মাসে চারদিন মাঠে যান, এমন রিপোর্টার এখন কজন?‌ ইডেনে বা যুবভারতীতে ম্যাচ থাকলে একটা উৎসাহ থাকে (‌সেটাও মূলত ছবি তোলার কারণে)‌। তার বাইরে প্র‌্যাকটিস দেখা বা নিছক খবরের খোঁজে ক্লাবে যাওয়া প্রায় উঠেই গেছে। ফোনে খোঁজ নিতেও বড্ড অনীহা। ফেসবুকে কোনও একটা পোস্ট চোখে পড়ল। তা থেকেই যেটুকু খবর হল। মাঠের সাংবাদিকতাও বড় বেশি ফেসবুক নির্ভর হয়ে পড়েছেন।

আর সাহসিকতা? যত কম বলা যায়, ততই ভাল। ময়দানের একের পর এক অনিয়ম, বেনিয়ম। তেমন ঝাঁঝালো লেখা কই? মুখ্যমন্ত্রীর দাদা আর ভাই প্রায় সব খেলার দখল নিয়ে বসেছেন। জুটে গেছেন ভাইপোও। গত বছর কলকাতা লিগের ফল এখনও ঘোষণা করাই যায়নি। পাছে ভাইপো চটে যান। বড় ম্যাচের টিকিট কাউন্টারে কাটার উপায় নেই। হাজার হাজার টিকিট চলে যাচ্ছে কাউন্সিলরদের হাতে। সন্তোষ ট্রফির কোচ কে হবেন, কোনও নিয়মের তোয়াক্কা না করে ক্রীড়ামন্ত্রী ঘোষণা করে দিচ্ছেন। অধিকাংশ ক্লাব কার্যত পার্টি অফিসে পরিণত। একের পর ভাঁড় ময়দানের দখল নিয়েছে। এদের এত স্পর্ধা হয় কীভাবে? হয়, কারণ, তামাম সাংবাদিককূল এঁদের অনুগ্রহপ্রার্থী। দন্ত বিগলিত করে এঁদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন। হয়ত বলবেন, এঁদের বিরুদ্ধে লিখলে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু উপেক্ষা তো করা যায়। দন্ত বিগলিত করে পাশে দাঁড়ানো থেকে তো বিরত থাকা যায়।

ডেস্কের কপিতেও বড্ড বেশি কেরানির গন্ধ। এজেন্সি বা পোর্টাল যে অ্যাঙ্গেলে কপি করছে, হেডিং করছে, কাগজেও ঠিক তাই। একটু অন্যভাবে ভাবার চেষ্টা, একটু অন্যভাবে লেখার চেষ্টা চোখেই পড়ছে না। মন কেড়ে নেওয়া দু একটা হেডিং যদিওবা থাকে, খুব কম ডেস্কের কপিতে প্রাণ খুঁজে পাই। নিতান্ত দায়সারা গোছের দু’‌শো বা আড়াইশো লিখে দেওয়া। জানা আছে, বাইলাইন পাওয়া যাবে না। কে আর মাথা খাটায়?‌ কে আর ভেবেচিন্তে ভাল লেখা দাঁড় করায়?‌

কম বেশি সবাই যেন রিফ্লেক্টেড গ্লোরিতে আচ্ছন্ন। তারকার পাশে দাঁড়ানো। ছবি তোলা। আর ব্রেকিং নিউজের মতো সেটা ফেবুতে সাঁটিয়ে দেওয়া। সৌরভ গাঙ্গুলি কোনও অনুষ্ঠানে গেলেই হল। কে কাকে ধাক্কাধাক্কি করে আগে পাশে দাঁড়িয়ে ছবিটা তুলবেন, তার প্রতিযোগিতা। সৌরভ আগে দেবাশিস দত্ত, গৌতম ভট্টাচার্য, এলপি শাহিদের দেখেছেন। যাঁরা এক্সক্লুসিভের লড়াই করতেন। সৌরভ জানতেন, এঁদের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। জানতেন, কোথাও কোথাও এই সাংবাদিকরাও তাঁর মুশকিল আসান করে দিয়েছেন। তাই কোথাও একটা সমীহও করেন। কিন্তু এখন ছবি তোলার লড়াই। কখন ফেসবুকে সেই ছবি ছাড়বেন, তার লড়াই। সৌরভ ভাল করেই জানেন, এঁদের দৌড় ওই পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা পর্যন্তই। এঁরা কোনওদিন তাঁর কোনও কাজেই আসবেন না। এরপর সৌরভ তাঁদের সমীহ করবেন?‌ নাকি করুনার চোখে দেখবেন?‌

ইডেনের প্রেস বক্সে গেলে তো কথাই নেই। ‘‌অনেকদিন পর ইডেনের প্রেসবক্সে’‌ মার্কা ক্যাপশান দিয়ে ছবি। যেন কত ল্যাপটপে কাজে মগ্ন। অথচ, চোখ সেই ক্যামেরার দিকেই। ইডেন যেতে না পারলে আর সেটা ঢাউস করে প্রচার করতে না পারলে যেন জীবন বৃথা। যুবভারতীর ক্ষেত্রেও একই কথা। এখানে ভেনু বদলে যুবভারতীর প্রেসবক্স। ক্রিকেটারদের গা ঘেঁসে ছবি তোলার সুযোগটা আপাতত কম। তখন ঝাঁপি থেকে বেরিয়ে আসে পুরনো ছবি। কারও একটা জন্মদিন হলেই সাঁটিয়ে দাও। তারকার পাশে আমি। লাইক, কমেন্ট কিছু পড়ে যায়। এতেই বেজায় তৃপ্তি।

অথচ, কে কটা খবর করেছে, হদিশ পাওয়া কঠিন। দু–‌একজন হাতে গোনা রিপোর্টার ছাড়া অধিকাংশের ঝুলিতে বছরে একটাও খবর নেই। মন কেড়ে নেওয়া লেখাও নেই। প্রিভিউ আর প্রেস কনফারেন্সে বাইলাইন।

মোদ্দা কথা, না আছে পরিশ্রম। না আছে পড়াশোনা। না আছে মেধা। না আছে লেখার মুন্সিয়ানা। না আছে সেই পর্যায়ের যোগাযোগ। না আছে ন্যূনতম সংযম।

তাহলে, রইলটা কী? ‌

ক্রীড়া সাংবাদিক দিবসে কি আয়নার সামনে দাঁড়াবেন এই প্রজন্মের ক্রীড়া সাংবাদিকরা?‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *