সরল বিশ্বাস
ইদানীং থ্রিলারের খুব ধুম পড়েছে। কী সিনেমায়, কী সাহিত্যে। এমনকী ওয়েব সিরিজ বা সিরিয়ালেও। সবসময় একটা চমক দেওয়ার চেষ্টা। অহেতুক সাসপেন্স আনা। বিকট মিউজিক। কাহিনির মোচড় দিতে গিয়ে মুড়ি মুড়কির মতো খুন করা।
এমনিতে নন্দিতা চ্যাটার্জি ও শিবপ্রসাদ মুখার্জির জুটি বরাবর অন্য ঘরানার ছবিই উপহার দিয়ে এসেছে। একটা নিটোল পারিবারিক গল্প। অন্যরকম ভাবনাকে উস্কে দেওয়া। কিন্তু আগের দুটো ছবিই জোর করে সাসপেন্স আর থ্রিলার বানাতে গিয়েছিলেন। এক বছর পুজোয় এসেছিল রক্তবীজ। গতবার পুজোয় বহুরূপী। সত্যি কথা বলতে কী, এই দুটো ছবিই তেমন ভাল লাগেনি। সবাইকে সব ঘরানার ছবি করতেই হবে, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? থ্রিলার করার অনেক লোক আছে। শিবু–নন্দিতা জুটি কেন সেই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাবে?
যাক, এবার অন্তত সেই থ্রিলারের পেছনে আর ছোটেননি। অহেতুক মারামারি বা রক্তারক্তি নেই। খুন, জখম নেই। পরিবারের গল্প। পরিবারকে ছাপিয়ে বৃহত্তর পরিবারের গল্প। একসঙ্গে বেঁচে থাকার গল্প। যাকে যেটা মানায়। হ্যাঁ, শিবু–নন্দিতা জুটিকে এটাই মানায়। বৈচিত্র আনা মানেই বুঝি থ্রিলার, খুনোখুনি, ডাকাতি — এসব গল্প ফাঁদতে হবে! কেন, এই গল্পে বুঝি বৈচিত্র নেই! একটি প্রকাশনা সংস্থা। বেলাশেষে বা বেলাশুরুতেও একজন প্রকাশকের গল্প ছিল। কিন্তু এই গল্পে প্রকাশনার জগৎ যেন আরও একটু উন্মুক্ত। এক আপাত রাগী বস। আর সেই অফিসের কর্মীরা। কাজ আছে, আবার কর্পোরেট জগতের নির্মম পেশাদারিত্বও আছে। কোথাও একটা দম বন্ধ করা আবহও আছে।
সেই আবহটাই হঠাৎ করে বদলে গেল। একটা খোলা হাওয়া যেন উঁকি দিল। সেই খোলা হাওয়া এনে দিলেন বসের মা। রাখি গুলজার। তিনি যেন বসের বস। তিনি প্রকাশনা ব্যবসার খুঁটিনাটি বোঝেন না। কর্পোরেট আদব কায়দাও বোঝেন না। তিনি ছেলের সঙ্গে অফিসে আসা শুরু করলেন। তাঁর ইউএসপি মাতৃস্নেহ। কর্মীদের সমস্যা বোঝা, তাদের আরও আপন করে নেওয়া। এভাবেই এগিয়ে চলে গল্প। এক সময় মনে হল, কর্মীরা তো অফিসে আসছে। তাদের বাবা–মা বাড়িতে সবসময় দুশ্চিন্তায়। আবার বাবা–মার জন্য ছেলে–মেয়েরও দুশ্চিন্তা কম নয়। বাবা–মাকেও যদি অফিসে নিয়ে আসা যায়! তাহলে কি কর্মীদের কাছ থেকে আরও ভাল কাজ পাওয়া সম্ভব? ভাবনাটা বেশ অভিনব। কর্পোরেট অফিসগুলোকে যেন নতুন দিশা দেখিয়ে গেল এই ছবি।
দীর্ঘদিন বাদে বাংলা ছবিতে ফিরলেন রাখি গুলজার। অবশ্যই কেন্দ্রীয় চরিত্রে। নিছক নায়ক বা নায়িকার মা বা জেঠিমা হয়ে নয়। বর্ষীয়ান অভিনেত্রীকে এভাবেই ট্রিবিউট দিতে হয়। ছেলের চরিত্রে শিবপ্রসাদ বেশ বিশ্বাসযোগ্য ও মানানসই। লেখকদের সঙ্গে বৈঠকের একটা দৃশ্য আছে। সেখানে জয় গোস্বামী, প্রচেত গুপ্ত, শ্রীজাত বা তিলোত্তমা মজুমদারদের দেখানোর বিষয়টি অভিনব। খামতি কি নেই! শিবপ্রসাদের স্ত্রীর চরিত্রে শ্রাবন্তীকে একেবারেই বেমানান লেগেছে। হঠাৎ করে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আদলে একটি চরিত্র তৈরি করে তাঁকে দিয়ে যা যা করানো হল, তা ভাঁড়ামির স্তরেই চলে গেল। এই দৃশ্য ছবিকে কিছুটা হলেও লঘু করে দিল। গানের ব্যবহার কিছুটা যেন অকারণেই। ওই গানগুলো না থাকলেও কোনও ক্ষতি হত না।
তারপরেও এই ছবি সংবেদনশীল। সবাই মিলে দেখার মতোই। ছবি শেষ হবে, অনুরণন থেকে যাবে। সাসপেন্স, থ্রিলারের মোহ ছেড়ে আবার যে তাঁরা নিজেদের ঘরানায় ফিরেছেন, এই ঘরওয়াপসিকে স্বাগত জানানোই উচিত।
