সৌরভ, বিদ্বেষ ছড়ানো আপনাকে মানায়!‌

অজয় নন্দী

যে পারছেন, যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিচ্ছেন। দেশপ্রেমের নামে হিংসা ছড়িয়ে যাচ্ছেন। কী আশ্চর্য, তাঁদের সেই কথাগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই সব বিদ্বেষমূলক কথার জন্য তাঁরা বাহবা পাচ্ছেন।

সেই তালিকায় এসে গেলেন সৌরভ গাঙ্গুলিও। তিনিও বলে বসলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্ত ক্রিকেটীয় সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত। দ্বিপাক্ষিক সিরিজ তো নয়ই, এমনকী নিরপেক্ষ জায়গাতেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলা উচিত নয়।

সৌরভের এই জাতীয় মন্তব্য ফলাও করে ছাপা হয়েছে বিভিন্ন সংহবাদপত্রে। এতদিন বাঙালি ব্যস্ত ছিল সৌরভকে ট্রোলিংয়ে। কেন তিনি মুখ্যমন্ত্রীর বিদেশ সফরে হাজির ছিলেন?‌ কেন তিনি সরকারি প্রকল্পে হাজির থাকছেন?‌ সেখান থেকে চটিচাটা, ধান্দাবাজ, এমন কত বিশেষণ ভেসে এসেছে।

কার নামে কোন কথা বলছি, খেয়ালও থাকছে না। যেন সৌরভের কাজ হল মমতার সঙ্গে দিনরাত যুদ্ধ করা। যেন সৌরভের কাজ হল শুভেন্দুর মতো রাস্তায় নেমে মিছিল করা। প্রথমত, সৌরভ কোথাও কোনও রাজনৈতিক ভাষণ দেননি। সরকারি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী যদি বারবার ডাকেন, হাজির থাকাটা একটা প্রাথমিক সৌজন্য। হয়তো দশবার ডাকলে নবার এড়িয়েও যান। আমরা সেই খবর রাখি না। একবার গেছেন। অতএব, কত গালাগাল যে জোটে!‌

অথচ, সেই সৌরভ যখন সম্প্রীতির বদলে ক্রিকেটীয় সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বললেন, তখন সমালোচনা হল না। ধন্য এই দেশ। ধন্য এই দেশের মিডিয়া। যেটার জন্য সমালোচনা হওয়া দরকার, সেখানে আমরা কী নীরব!‌ কারণ, এক্ষেত্রে সৌরভের বক্তব্য যেন বিজেপির বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায়।

সময়টা ২০০৪। কারগিল যুদ্ধের পর দীর্ঘদিন ভারত–‌পাক সিরিজ বন্ধ ছিল। আবার সেই সিরিজ চালু হওয়ার পথে। ভারত যাবে পাকিস্তান সফরে। ভারতীয় দল রওনা হওয়ার আগে গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর কাছে। যথার্থ রাষ্ট্রনায়কের মতোই বলেছিলেন, ‘‌দিল ভি জিতকে আনা।’‌ সৌরভরা সেবার শুধু টেস্ট সিরিজই জেতেননি, পাকিস্তানবাসীর হৃদয়ও জিতে ফিরেছিলেন।

দুই দেশের রাজনীতিকরা পরিস্থিতিকে জটিল করেছেন। কিন্তু খেলোয়াড়দের মধ্যে সেই বৈরিতা আসেনি। তাই পাক ক্রিকেটাররা অনায়াসে সুনীল গাভাসকারের কাছে আসেন পরামর্শ নিতে। আবার ভারতীয় বোলাররাও বিনা দ্বিধায় ওয়াসিম আক্রামের কাছে যান সুইং বোলিং শিখতে। হ্যাঁ, ক্রিকেট এভাবেই মিলেমিশে থাকতে শেখায়।

কিন্তু সরকার চায় না সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকুক। তাই আইপিএলের নিলামে পাক ক্রিকেটারদের নেওয়া চলবে না। অদ্ভুত ফতোয়া (‌এই ফতোয়া অবশ্য মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই)‌। দুই দেশের সিরিজ বন্ধ। এশিয়া কাপ হোক বা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, ভারতীয় দল পাকিস্তানে খেলতে যায় না। তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতে হয়। ভারতীয় বোর্ডের গায়ে যতই ‘‌স্বশাসিত সংস্থা’‌র তকমা থাকুক, তারা যে সরকারের একটি লেজুড় এটা না বললেও চলে।

কিন্তু সৌরভ, আপনার কি দায় পড়েছিল দুই দেশের মধ্যে এভাবে তিক্ততা বাড়ানোর?‌ ঘৃণা ছড়ানোর লোক কি কম পড়িয়াছে?‌ অমিত শাহর পুত্রর অঙ্গুলি হেলনে বোর্ড চলে, আইসিসি চলে। তাঁকে ঘিরে চ্যালাচামুন্ডারাও তেমনই হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য তারাই যথেষ্ট। আপনাকে কে আসরে নামার দিব্যি দিল?‌ নাকি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার বার্তা দিয়ে বিজেপিকেও ফের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে রাখলেন?‌

যে কথাগুলো কঙ্গনা রানাওয়াতদের মানায়, সেগুলো আপনাকে মানায় না। সেই কত কাল আগে বাজপেয়ীজি আপনাকে বলেছিলেন, দিল ভি জিতকে আনা। আপনার দায়িত্ব অনেক বেশি। যে বিকৃত প্রচারকে দেশপ্রেম বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে আপনার গলা মেলানোর দরকার নেই। ভুলে যাবেন না, আপনি হৃদয় জিতে ফিরেছিলেন। বিদ্বেষ ছড়ানোর অধিকার অন্তত আপনার নেই।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.