সরকার দাঙ্গার চাষ করে, তাই দাঙ্গা হয়

রক্তিম মিত্র‌

অনেকদিন আগের নেওয়া ইন্টারভিউ। এখনও ইউটিউবে খুঁজলে পাওয়া যায়। একদিকে জ্যোতি বসু। তাঁর সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন জাভেদ আখতার। বিষয় ছিল, বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। এই রাজ্যে কেন দাঙ্গা হয় না?‌ খুব সহজ উত্তরে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘‌কিঁউ কি হুকুমত নেহি চাহতি।’‌ অর্থাৎ, প্রশাসন চায় না, তাই দাঙ্গা হয় না।

কথাটা আপাতভাবে বেশ মামুলি। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে তার তাৎপর্য মারাত্মক। অল্প কথায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয় না। যত দিন যাচ্ছে, কথাটার মর্ম যেন বুঝতে পারছি। তখনও সময় বেশ উত্তাল ছিল। নব্বইয়ে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে ছুটছে আদবানির রথ। যে রাজ্যের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, সেই রাজ্যেই অনিবার্য দাঙ্গা। বাংলার মাটি রক্তাক্ত হয়নি। কারণ প্রশাসন সজাগ ছিল। তারও দু’‌বছর পর। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস। গোটা দেশজুড়ে দাঙ্গা পরিস্থিতি। কলকাতা বা বাংলাতেও তার ছোঁয়া লাগতেই পারত। কিন্তু পরিস্থিতি আগাম আঁচ করে দ্রুত সেনা নামিয়ে পরিস্থিতি আয়ত্বে এনেছিলেন জ্যোতি বাবু।

জ্যোতি বসু কতখানি সফল, কোথায় অসফল, তাই নিয়ে নানা আলোচনা চলতেই থাকে। কিন্তু তিনি কত দূরদর্শী প্রশাসক ছিলেন, অন্তত এই দুই ঘটনা থেকে পরিষ্কার। কিন্তু এখন দাঙ্গা যেন জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। কিছু একটা উপলক্ষ পেলেই হল। কখনও হাওড়ার গ্রামাঞ্চলে, কখনও উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকায়। আর মালদা, মুর্শিদাবাদ তো আছেই। সমাজমাধ্যমে যেসব ছবি ছড়িয়ে যাচ্ছে, তা ভয়াবহ। উস্কানি ছড়ানোর জন্য ভুয়ো ছবি আছে, এটাও ঘটনা। কিন্তু সত্যি ছবিগুলোও মারাত্মক। শুধু ধর্মের নামে এই হিংসা, হানাহানি— প্রশাসন কার্যত নীরব দর্শক।

দাঙ্গায় কার লাভ?‌ একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে। একদল তাকিয়ে সংখ্যালঘু ভোটের দিকে। অন্যদল সংখ্যালঘুদের জুজু দেখিয়ে সনাতনী ভোট বাক্সে পুরতে মরিয়া। কেউ বলছেন ইসলাম খাতরে মে হ্যায়। কেউ বলছেন, হিন্দু খাতরে মে হ্যায়। দশ বছর আগেও তো কেউ এতখানি ‘‌খাতরে মে’‌ ছিল না। হঠাৎ, এমন বিপদ নেমে এল কেন?‌ একদল বুঝে গেছে, মুসলিম ভোট যদি ঠিকঠাক বাক্সে ঢুকে যায়, হাজার দুর্নীতি করলেও কোনও চিন্তা নেই। তিরিশ হাতে নিয়ে খেলতে নামলে বাকি পনেরো ঠিক এসে যাবে। অন্য দলের হাতে আছে সিবিআই, ইডি। আছে আস্ত একটা কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু ব্যর্থতার পাল্লা এতটাই ভারী যে, হিন্দু হিন্দু করা ছাড়া গতি নেই। এগারো বছর ধরে মোদি প্রধানমন্ত্রী, তারপরেও যদি বলতে হয়, হিন্দু খাতরে মে হ্যায়, সেটা যে কতবড় লজ্জার, এই আহাম্মকরা এই সহজ সত্যিটুকুও বোঝেন না।

কেউ হিন্দুর জুজু দেখাচ্ছেন। কেউ মুসলিম জুজু দেখাচ্ছেন। এই জুজু দেখানোই ওঁদের হাতিয়ার। এঁরাই কেউ রাজ্যে, কেউ কেন্দ্রে সরকার চালাচ্ছেন। সরকারের কাজ কী, এই অর্বাচীনরা সত্যিই জানেন না। কোন মঞ্চে কোনটা বলতে হয়, কোন মঞ্চে কোনটা বলতে নেই, এই ন্যূনতম শিক্ষাটুকুই নেই। এঁরা চালাবেন প্রশাসন?‌ নিজেদের সীমাহীন ব্যর্থতা ঢাকতে দাঙ্গাই এদের হাতিয়ার। ঘর জ্বলুক, মানুষ প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যাক। এঁরা সেই আগুনে রুটি সেঁকবেন। দায়ী আমরাই। যেমন প্রশাসক আমাদের পাওয়ার কথা, তেমনটাই তো পেয়েছি।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.