স্বরূপ গোস্বামী
বেশ কয়েকদিন আগের কথা। মুখ্যমন্ত্রী গিয়েছিলেন লন্ডন সফরে। কেলগ কলেজের আমন্ত্রণে। সেখানে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। একদল প্রবাসী বাঙালিকে দেখা গেল, পোস্টার নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। পেছন থেকে চিৎকার করছেন। মুখ্যমন্ত্রীকে বাধা দিচ্ছেন।
সত্যিই বিষয়টি ভাল লাগেনি। মনে হয়েছিল, এটা শিষ্টাচার বিরোধী। আপনি মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিকভাবে বিরোধী হতেই পারেন, তাঁর সব কথা আপনার পছন্দ না হতেই পারে। কিন্তু সেখানে তিনি বাংলার প্রতিনিধি, দেশের প্রতিনিধি। সেখানে তিনি আমন্ত্রিত অতিথি। এভাবে তাঁকে বিক্ষোভ দেখানো বা তাঁর সভা পণ্ড করার চেষ্টাকে কিছুটা অশোভনীয়ই মনে হয়েছিল।
কিন্তু সোমবার নেতাজি ইনডোরে যদি এমন কোনও উদ্যোগ দেখি, মন থেকে সেই বিক্ষোভকারীকে কুর্নিশ জানাব। চাকরি বাতিল সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর মুখ্যমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্স দেখছিলাম। এই বাংলায় পদলেহনকারির অভাব নেই। তাঁদের কেউ কেউ তাঁকে মানবিক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই প্রেস কনফারেন্স শোনার পর তাঁকে একজন মুখ্যমন্ত্রী ভাবতে কিছুটা লজ্জাই হচ্ছে। একজন প্রশাসক কতটা অপদার্থ হলে, একজন মানুষ কতখানি নিম্নরুচির হলে, এই জাতীয় প্রেস কনফারেন্স করতে পারেন।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সীমাহীন দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে। প্রমাণের ছড়াছড়ি। প্রমাণ লোপাটেরও ছড়াছড়ি। একের পর এক সরকারি দপ্তর ব্যস্ত সেই প্রমাণ লোপাটের খেলায়। আস্ত একটা ক্যাবিনেট নজিরবিহীনভাবে সেই কেলেঙ্কারিকে ধামাচাপা দিতে চাইল। তারপরেও মুখ্যমন্ত্রী এমন ভান করছেন যেন তিনি কিছুই জানতেন না। যেন তাঁর সরকারের সমস্ত অপকর্মের দায় বিরোধীদের আর বিচারপতিদের। তিনি নাকি নেতাজি ইনডোরে চাকরি হারা শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করতে চান। তাঁদের কথা শুনতে চান। সেই চাকরিহারা শিক্ষকদের কথা শোনার ক্ষমতা আছে? এত সৎসাহস আপনার আছে? কিছু পেটোয়া লোকজন থাকবে। তাঁরা আপনাদের শেখানো বুলি বলবে। আর তারপরই আপনি মাইক হাতে তুলে নিয়ে আবোল তাবোল বকে যাবেন। যেমন ঈদের মঞ্চ থেকে বলেন, যেমন সরকারি সভা থেকে বলেন, যেমন বইমেলার মঞ্চ বা ফিল্ম ফেস্টিভালের মঞ্চ থেকে বলেন।
আপনার সরকারের সীমাহীন দুর্নীতির জন্য হাজার হাজার শিক্ষকের চাকরি গেল। আপনি একফোঁটাও অনুতপ্ত নন। উল্টে এরপরেও আপনি বিরোধীদের গালমন্দ করে যাচ্ছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে লোককে ক্ষেপিয়ে তুলছেন। অর্থাৎ, ইনডোরের সেই সভাতেও ঘৃণা ছড়াবেন। লন্ডনে পেটোয়া বাহিনীর দ্বারা পরিবৃত ছিলেন। ইনডোরে কিন্তু থাকবেন চাকরি হারা শিক্ষকরা। অনেকেই অসহায়। অনেকেই এরপরেও আপনার ওপর ভরসা রাখতে চাইবেন। কিন্তু ওঁদের অধিকাংশই মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, ওঁদের এই খাদের কিনারে টেনে আনার মূল নায়ক আপনার সরকার। তাঁরা কিন্তু বিক্ষোভ দেখাতেই পারে।
আপনার পুলিশ তখন কী করবে? এটা নিজের চেনা মাঠ? পুলিশ লেলিয়ে দিতেই পারেন। মিথ্যে মামলা দিতেই পারেন। ভবিষ্যতে যেন আর চাকরি না হয়, তা নিশ্চিত করতে পারেন। কিন্তু এরপরেও বিক্ষোভ হতে পারে। অন্য কোনও দলের প্ররোচনা দরকার নেই। তাঁদের মনের ভেতর যে আগুন জ্বলছে, সেই আগুনই আগ্নেয়গিরি হয়ে লাভা বর্ষণ করতে পারে।
লন্ডনে সভা ভন্ডুলের চেষ্টাকে ধিক্কার জানিয়েছিলাম। কিন্তু এখানে আন্তরিকভাবেই চাই, আপনার জন্য অপেক্ষা করে থাকুক তীব্র ঘৃণা আর ধিক্কার। ঢোকার মুখেই যেন শুনতে হয়ে গো ব্যাক স্লোগান। চোর চোর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠুক নেতাজি ইনডোর। একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে এমন সম্ভাষণ হয়তো শোভনীয় নয়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, শোভনতা, শালীনতা প্রত্যাশা করার অধিকারটুকুও তাঁর নেই। এই ধিক্কারই তাঁর প্রাপ্য। খুঁজছি সেই শিশুকে, যে এসে চিৎকার করে বলবে, রাজা তোর কাপড় কোথায়!