সেই একই কুনাট্য চলছে

মলয় রক্ষিৎ

এই বিপর্যয় আসলে আজই নেমে এল, এমন তো নয়। প্রায় একদশক ধরে রাস্তায় ফুটপাতে বসে থাকা চাকরি প্রার্থীদের আর্ত স্বর আমরা এতদিন শুনেও না শোনার ভান করেছি। হাইকোর্টের এজলাসে দুর্নীতির দায়ে হাড় কঙ্কাল বের হওয়া পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা দপ্তরের নাঙ্গা রূপ দেখেও চুপ থেকেছি। এসএসসি হোক বা পিএসসি, কিংবা কলেজ সার্ভিস কমিশন —বিগত কয়েক বছরে এই অফিসগুলোতে চাকরি নিয়ে দুর্নীতি আর কারচুপির ঘটনাগুলো যতবার সামনে এসেছে, আমরা রাগে ঘৃণায় কেউ-ই কিন্তু ফেটে পড়িনি।

আইন আইনের পথে চলবে –এই লব্জ মনে রেখে আদালতের উপরেই যেন ছেড়ে দিয়েছিলাম বিচারের ভার। ফলে, এই রায়ে আমরা আজ বেদনাহত হলেও বিস্মিত নই। ভাবছি দুর্নীতি কিছু তো হতেই পারে, কিন্তু তাই বলে এরকম রায়? যেন যাবতীয় দোষ আদালতের, শিক্ষা দপ্তরের নয়।

আদালত একবারও প্রশ্ন তোলেন না, মন্ত্রিসভার সেই সব কর্তাব্যক্তির বিরুদ্ধে– যাঁরা যোগ্য আর অযোগ্য আলাদা করতে চাইলেন না। যাঁরা নানা উপায়ে চেষ্টা করলেন যাতে অযোগ্যদের কিছুতেই নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত না করা যায়, যাতে দুর্নীতির চিহ্নগুলো মুছে ফেলা যায়। বিচারপতিরা দুর্নীতির সেইসব দিকগুলি পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং তাঁদের রায়ে বিশদে উল্লেখও করেছেন। অথচ যাঁদের নেতৃত্বে এই দুর্নীতি সম্ভব হল, সেইসব মন্ত্রী, আমলা, কমিশন-আধিকারিক এবং কর্মচারীদের বরখাস্ত করা কিংবা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার কথা তাঁরা একবারও বললেন না।

কেন বললেন না? —কেন না, আদালতে তাঁদের বিরুদ্ধে তো কোনো মামলা হয়নি। সুতরাং আইন আইনের পথে চলবে, দুর্নীতির কারিগরেরা নিরাপদে থাকবেন। অসৎ আর অযোগ্যদের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্ধ হবেন হাজার হাজার যোগ্যরাও।

আমি নিশ্চিত, শাসক এই রায়ই চেয়েছিলেন। তাঁরা ভালো করেই জানতেন যে –রায় এটাই হতে যাচ্ছে। তাই আদালত যতই বলুক, অযোগ্যদের ঠিকঠাক চিহ্নিত করবার দায় তাঁরা নেয়নি। শাসক ভালো করেই জানেন, এ রাজ্যে শিক্ষক আর সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যবধান আজ পর্বতপ্রমাণ। শিক্ষক সম্প্রদায়ের উপর ন্যূনতম কোনো সমর্থন কিংবা সহানুভূতি সাধারণ মানুষের নেই। এবং এটাই শাসকের অস্ত্র। তাঁরা ভোটারদের এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, পড়াশোনা করে কিছু হয় না। বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, ঘুষ না দিয়ে চাকরি পাওয়া যায় না। যে কোনো চাকরিই আসলে ঘুষ অথবা আনুগত্যের বিনিময়ে পাইয়ে দেওয়ার ফল। ফলে যোগ্যতা নয়, সফলতার উপায় মাত্র দুটি –আনুগত্য অথবা ঘুষ।

আদালতের এই রায়ে যোগ্য এবং অযোগ্য নির্বিশেষে যাঁদের চাকরি খোয়া গেল, আমি জানি তাঁদের অনেকে এই রায়কে ‘ভাগ্যের মার’ বলেই ধরে নেবেন। তাঁরা যে আস্তিক্যবাদী। তাঁরা ঈশ্বরের ‘লীলা’য় বিশ্বাস করেন। তাই যে-কোনো বিপর্যয়কেই তাঁরা ঐশ্বরিক লীলা বলে ভাবতে পারেন, তাঁদের পক্ষে সেটা ভাবা সমুচিতও। ফলে তাঁরা কি রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে যাবেন? শাসকের কাছে এই ধার্মিকদের মূল্য সবসময়ই বেশি। ধর্মের প্রতি আনুগত্যই হোক বা শাসকের প্রতি আনুগত্য —আমার কাছে তা হল একই পয়সার এপিঠ-ওপিঠ।

যাঁরা ঘুষ দিয়ে অসৎ উপায়ে চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁরা কেউই কিন্তু রাগে ফেটে পড়ছেন না। কাদের তাঁরা ঘুষ দিয়েছিলেন, কোন কোন দালাল/নেতার কথায় তাঁরা ভরসা পেয়েছিলেন, তাঁদের নাম কেউ সামনে আনছেন না। রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদী হওয়ার সাহস বোধহয় এ রাজ্যের চাকরি প্রার্থীদের নেই। আপাতত তাঁরা প্রতিবেশী বিহারের আসন্ন স্কুল সার্ভিস পরীক্ষার দিকে তাকিয়ে আছেন। কেউ কেউ এই বিপর্যয়ের দায়ভাগে কে বা কারা আছেন– হিসেব করছেন। কবিতার পঙক্তি উদ্ধৃত করে নিজেরও দায় খুঁজছেন।

এদিকে আরও অজস্র মামলা ঝুলে আছে। কলেজ সার্ভিস কমিশন আদালতে গা জোয়ারি করে আবারও বলবেন—মেরিট লিস্টে প্রার্থীদের কীসে কত নম্বর দেওয়া হয়েছে তার ডিটেলস দেখাব না। ইন্টারভিউর ভিডিওগ্রাফি করব না। স্কুল সার্ভিস কমিশন বলবেন, প্রার্থীদের উত্তরপত্রের ডুপ্লিকেট দেব না, ডিটেলস নম্বর আপলোড করব না। আদালতে লাল-সবুজের দড়ি-টানাটানি খেলা চলবে। আদালত দুরন্ত শাসকের আবদার আবারও বার বার মেনে নেবেন। আবারও ঘটা করে চাকরির অ্যাড বেরোবে। সিভিক ভলান্টিয়ার ও পার্টি স্বেচ্ছাসেবকদের ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষাকেন্দ্রের সম্মুখে জলসত্র ক্যাম্প বসবে। এবং যথারীতি সরকারের ছত্রিশ মাসেও বছর শেষ হবে না। আবারও অনুদান প্রত্যাশী ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষায় ভীড় বাড়বে। কিচ্ছু করার নেই বলে তাঁরা পিএইচডি করার লাইনে গিয়ে দাঁড়াবে… এক দশকের বেশি সময় ধরে এইসব চিত্রনাট্যই দেখে আসছি।

 

Share