রক্তিম মিত্র
সমস্যাকে সুযোগে বদলে ফেলতে তাঁর জুড়ি নেই। যেখানে তাঁর হাতজোড় করে ক্ষমা চাওয়ার কথা, যেখানে তাঁর পদত্যাগ করার কথা, সেখানেও তিনি কী অবলীলায় অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিতে পারেন! নিজের যাবতীয় অপরাধকে ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দিতে পারেন!
যথারীতি এবারও তাই হল। ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি গেল। এই তালিকায় অনেকে অযোগ্য যেমন আছেন, তেমনই অনেকে যোগ্যও আছেন। হাইকোর্ট বারবার বলেছে, যোগ্য–অযোগ্যর তালিকা আলাদা করতে। এসএসসি কার্যত কিছুই করেনি। রাজ্য সরকার কার্যত কিছুই করেনি।
হাইকোর্টের রায় বাতিল করতে সুপ্রিম কোর্টে গেছে। সেখানেও সুপ্রিম কোর্ট অনন্ত সময় দিয়েছে। এসএসসি হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে, যোগ্য এবং অযোগ্য আলাদা করা সম্ভব। কিন্তু মাসের পর মাস গড়িমসি করেছে। এখন মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, আমাদের দায়িত্ব দিলে আমরা চেষ্টা করতে পারতাম। এখন তিনি বলতে শুরু করেছেন, এসএসসি স্বশাসিত সংস্থা। পরীক্ষার তারিখ তিনি ঘোষণা করেন, গরমের ছুটিও তিনি ঘোষণা করেন। এইসব স্বশাসিত সংস্থার চেয়ারম্যানদের ভোটে দাঁড় করিয়ে দেন। জেতার পরেও তাঁরা পদ ছাড়েন না। এই রাজ্যে কোনও সংস্থাকে স্বশাসিত সংস্থা রেখেছেন?
কখনও দায়ী করছেন বিজেপিকে, কখনও দায়ী করছেন সিপিএমকে। কখনও ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন অভিজিৎ গাঙ্গুলিকে, কখনও বিকাশ ভট্টাচার্যকে। যেন সুপ্রিম কোর্টের রায় তাঁরাই দিলেন। হাইকোর্টে ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিলের যে রায়, সেটা অভিজিৎ গাঙ্গুলি দেননি। দিয়েছিল দেবাংশু বসাকের ডিভিশন বেঞ্চ। অথচ, সেটাকে তিনি বেমালুম অভিজিৎ গাঙ্গুলির রায় বলে চালিয়ে দিলেন।
সহজ কথা, এই নিয়োগের পেছনে ছোট খাটো দুর্নীতি নয়, একেবারে নির্লজ্জ স্তরের জালিয়াতি হয়েছে। এসএসসি চেয়ারম্যানের চোদ্দ পুরুষের ক্ষমতা ছিল না এই মাপের দুর্নীতি করার। যাঁরা সমস্ত প্রমাণ লোপাট করলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তো একটা কথাও বললেন না। যাঁরা কয়েকশো কোটি এখান থেকে উপার্জন করলেন, তাঁদের নামে তো একটি কথাও বললেন না।
এটা শুধু পার্থ চ্যাটার্জি বা মামুলি কয়েকজন বিধায়ক, সাংসদের কাজ নয়। অনেক বড় মাথার নির্দেশ না থাকলে এত বড় স্তরের জালিয়াতি করা যায় না। সেই মাথা কে? আপনি জানেন না? কীসের আপনি পুলিশ মন্ত্রী? অন্যান্য বিরোধীদের মতো এটা বলতে চাই না যে, এই টাকা আপনার কাছে এসে পৌঁছেছে। তাহলে আসল অপরাধীকে আড়াল করা হয়। তবে এই টাকার সিংহভাগ খুব প্রভাবশালী কোনও এক জায়গায় পৌঁছেছে, এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই। সেই কারণেই ক্যাবিনেটে আপনাকে নিয়ম বহির্ভূত ভাবে সুপার নিউমেরিক পোস্ট চালু করতে হয়। সেই কারণেই বছরের পর বছর সুপ্রিম কোর্টে মামলা ঝুলিয়ে রাখতে হয়।
সোজা কথা, এসএসসি বিরোধীরা চালায় না। অযোগ্যদের টাকা নিয়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়াটাও বিরোধীদের কর্ম নয়। অপরাধীদের বাঁচাতে বিরোধীরা সুপ্রিম কোর্টে ছোটেনি। সবকিছুর শুধু নৈতিক নয়, প্রত্যক্ষ দায় সরকারের। এত এত শিক্ষক ও তাঁদের পরিবারের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, তার জন্য সম্পূর্ণ এই অপরার্থ সরকারই দায়ী।
এখন আপনি অপেক্ষায়, যদি কেউ আত্মহত্যা করেন! তাঁর মৃতদেহ নিয়ে তখন আপনি হইচই বাঁধাবেন। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারকে কেউ এতখানি ঘৃণ্য জায়গায় নামাতে পারে, তা আপনি না থাকলে জানাই যেত না। এই সাংবাদিক সম্মেলনের পরেও যদি কেউ আপনাকে ঘৃণা না করে, তাহলে বুঝতে হবে, তাঁর শরীরে মানুষের রক্ত নেই।
