বইমেলার থিম!‌ আসলে ঘোড়ার ডিম

থিম নয়,
ঘোড়ার ডিম

বইমেলা মানেই এতদিন দেখে এসেছি উদ্ভট উদ্ভট সব থিম। কোনওবার পেরু, কোনওবার কোস্টারিকা, কখনও গুয়াতেমালা। উরি ব্বাবা। বইমেলার আয়োজকরা কত পণ্ডিত। সব দেশের সাহিত্য এঁদের গুলে খাওয়া হয়ে গেছে। এখন পেরু, চিলি, গুয়াতেমালা— এগুলোই যা বাকি।

আচ্ছা, কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে কি চীনের সিনেমা, ইরানের সিনেমা ইত্যাদি থিম থাকে? খাদ্য মেলায় কি মোগলাই খাবার, ইতালিয়ান খাবার ইত্যাদি থিম থাকে? থাকে না। মেলা মানে হরেক জিনিস ছড়িয়ে থাকবে। যার যেটা খুশি কিনবে। মেলার আবার থিম কী হে?

কিন্তু বইমেলায় থিম থাকে। এবং থিমের লিস্টি দেখে মনে হবে, বাংলা ভাষার, ভারতের সব ভাষার সাহিত্য গুলে খাওয়া হয়ে গেছে। তাই বিদেশ নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে। আচ্ছা বুকে হাত রেখে বলুন তো, আমরা কজন, সতীনাথ ভাদুড়ির লেখা পড়েছি? অদ্বৈত মল্লবর্ধনের লেখা পড়েছি? জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর লেখা পড়েছি? প্রমথনাথ বিশির লেখা পড়েছি? পড়া দূরের কথা, ৯০ শতাংশ বাঙালি এঁদের নাম শোনেনি। সদিচ্ছা থাকলে এঁদের বইমেলার থিম করা যেত। একেক মেলায় একেকজন। যেমন, গত কয়েকবছর ধরে প্রয়াত সাহিত্যিকদের নামে প্যাভিলিয়ন হয়েছে। ভাল উদ্যোগ। কিন্তু সেখানে ঢুকলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। এঁদের কোনও চিহ্নই নেই। এমনকী বাংলা ভাষার বইও খুঁজে মেলা ভার।

বাংলার বাইরে বেরতে চাইলে ভারতের কোনও রাজ্যকে থিম করা যেত। মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, অসম, ওড়িশা এই সব রাজ্য থিম হলে আমরা অমৃতা প্রীতম সিং, ইন্দিরা গোস্বামী, ফকিরমোহন সেনাপতি, আর কে নারায়ণন, গিরিশ কারনাড প্রভৃতি সাহিত্যিকদের সম্বন্ধে জানতে পারতাম। ভিনরাজ্যের সাহিত্য সম্পর্কে, সাহিত্যিকদের সম্পর্কে আমরা কতটুকুই বা জানি!‌ বইমেলার হাত ধরে যদি ভিনরাজ্যের সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যেত, মন্দ হত না।

কিন্তু ত্রিদিববাবুরা তো আন্তর্জাতিক বইমেলা করেন। রাজ্য বা দেশ নিয়ে থিম করলে তাঁদের মান–‌ইজ্জত চলে যাবে। তাছাড়া বিদেশ নিয়ে থিম করলে গিল্ড-এর খরচে সেই দেশটা ঘুরে আসা যায়। আমেরিকা, ফ্রান্স, স্পেন ঘোরা হয়ে গেছে। লাতিন আমেরিকাও বাকি নেই। পুরুলিয়ার খবর রাখে না, পেরুর গপ্পো ঝাড়ছে। কখনও থিম হয়েছে কোস্টারিকা, কখনও আবার গুয়াতেমালা। এঁদের গলায় যে কোন মালা পরাই!‌ কতসব বোদ্ধা। কোস্টারিকা, গুয়াতেমালার থিম বুঝে একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছে। কোনদিন হয়তো থিম হবে আন্টার্কটিকা। দু’‌বছর আগে থিম ছিল স্পেন। মুখ্যমন্ত্রী শিল্প আনবেন বলে স্পেনে ছুটলেন। কলকাতার ক্লাবের কর্তাদের ধরে নিয়ে গেলেন। বইমেলার কর্তাদেরও নিয়ে গেলেন। না এল শিল্প, না গেল সাহিত্য। এখানে স্প্যানিশ সাহিত্যের জোয়ার বয়েছে নাকি বার্সিলোনা, মাদ্রিদের দোকানে দোকানে বাংলা বইয়ের ছড়াছড়ি!‌

আগেরবার থেকে কিছুটা যেন সম্বিত ফিরেছে। স্প্যানিশ সাহিত্য থেকে এবার তাঁরা ইংরাজি সাহিত্যে ফিরেছিলেন। মানে, থিম হয়েছিল ব্রিটেন। এবার আবার জার্মানি। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি ফ্র‌্যাঙ্কফুর্ট বইমেলার কথা। প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী এই বইমেলার সঙ্গে কলকাতার তুলনা বহু বছর ধরেই শোনা যায়। গিল্ডের কর্তারা, এই বাংলার লেখকরা বহুবার সেই দেশে ঘুরেও এসেছেন। কিন্তু সে জার্মানিকে এতদিন থিম করা হয়নি, সেটাই আশ্চর্যের। কজন জার্মানির ওই স্টলে গিয়ে ছবি তুললেন আর কজন বই কিনলেন, সেই বিতর্ক না হয় থাক। কোস্টারিকা, গুয়াতেমালার থেকে অন্তত থিম হিসেবে জার্মানি মন্দ নয়।

বিদেশ ঘোরা তো অনেক হল। এবার না হয় দেশের দিকে একটু তাকানো যাক। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে থিম হোক। না হয় হিন্দি দিয়েই শুরু হোক।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.