মহাকুম্ভ নয়, দাদু–‌নাতির ঠিকানা বইমেলা

সুরঞ্জন পাত্র

এবার যেন কুম্ভ মেলায় যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। বারো বছর পর পূর্ণকুম্ভ বলে কথা। তার ওপর এবার নাকি মহাকুম্ভ। ১৪৪ বছর পর নাকি এমন মহাকুম্ভ দেখা যাবে। বেশ কয়েক মাস ধরেই এরকম একটা প্রচার চলছে। নতুন নতুন ট্রেন দেওয়া হয়েছে। রাস্তায়, চায়ের দোকানে— সব জায়গায় দেখছি, কুম্ভ নিয়েই আলোচনা। কে ট্রেনে টিকিট পেয়েছে, কে পায়নি, কে কোথায় গিয়ে ডুব দেবে, তা নিয়ে সবাই চর্চায় মশগুল।

মাঝে মাঝে ভাবি, আমার দেশটা হঠাৎ করে এত ধার্মিক হয়ে গেল কীভাবে?‌ যাঁরা ধর্ম মানেন, বিশ্বাস করেন, তাঁরা নিশ্চয় যাবেন। পূর্ণকুম্ভ হোক বা অর্ধকুম্ভ, আগেও অনেকে গেছেন। তাঁদের কাছে গল্প শুনেছি। সমরেশ বসুর ‘‌অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’‌ নিয়ে যে সিনেমা হয়েছে, সেটাও দেখেছি। কিন্তু এবারের মতো এমন মাতামাতি আগে কখনও দেখিনি। আমার অবশ্য কুম্ভে যাওয়ার বয়স নেই। সেই ইচ্ছেও নেই। আমি গিয়েছিলাম আমার তীর্থক্ষেত্রে, অর্থাৎ বইমেলায়। করুণাময়ীর বইমেলাই হয়ে উঠল আমাদের মহাকুম্ভ।

গতবছরও বইমেলার দিনগুলোয় টিভি চ্যানেলগুলো মেতে ছিল অযোধ্যার রাম মন্দির নিয়ে। মনে হচ্ছিল, দেশে যেন আর কোনও সমস্যাই নেই। যেন একটা মন্দিরই দেশের উন্নতির সোপান। যেন এই মন্দিরটা হয়ে গেলেই সারা বিশ্ব ভারতের নামে ধন্য ধন্য রব তুলবে। সেটা ছিল ভোটের বছর। তাই সেই হাওয়া তোলার একটা মরিয়া চেষ্টাও ছিল।

আমি বাপু নাস্তিক মানুষ। এতসব ধর্মকর্ম বুঝি না। ধর্মকে নিয়ে যদি কেউ বাণিজ্য করে, তখন তা থেকে আরও দূরে পালাই। এটুকু বুঝি, এই লোকটি ধার্মিকও নয়। এবার কুম্ভ নিয়ে যা হল, তার পেছনে কতটা স্বতস্ফূর্ত আবেগ আর কতটা সরকারি ইভেন্ট, বেশ সংশয় আছে। অনেক হল ধর্মচর্চা। আমার তাহলে করণীয় কী?‌ ঠিক করে নিলাম, কুম্ভে কী হচ্ছে, তা নিয়ে মাথা ঘামাব না। টিভি দেখব না। যাঁরা এতে মেতে আছে, মেতে থাকুক। আমি ঠিক করলাম, বইমেলায় যাব। আমি থাকি মফস্বলে। এখান থেকে শিয়ালদা প্রায় একঘণ্টার পথ। যাওয়ার সময় তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু ফেরার সময় বিস্তর ভিড়। তাছাড়া, বয়সটাও তো বাড়ছে। তবু ঠিক করে নিলাম, বইমেলাই যাব। সঙ্গে নিলাম দশ বছরের নাতিকে। শুধু নিজে টিভির ওই কুম্ভ–‌‌প্লাবন থেকে দূরে থাকলেই হবে না। মনে হল, ছোট্ট নাতিটাকেও এর থেকে দূরে রাখা দরকার।

দাদু–‌নাতি দুই ভাই মিলে চলে গেলাম মেলায়। আহ, যেন তাজা এক অক্সিজেন। আমার নাতিটি একটু ভোজনরসিক। বইয়ের থেকে খাবারের প্রতি একটু বেশি ঝোঁক থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই শুরুতেই মনে হল, ওর পেটটা আগে ঠান্ডা করা দরকার। নিয়ে গেলাম ফুড স্টলে। ওর পছন্দমতো জিনিস কেনা হল। আমিও সঙ্গ দিলাম।

ব্যাস, এবার তাহলে যাওয়া যাক বইয়ের সমুদ্রে। নিয়ে গেলাম দেব সাহিত্য কূটীরে। চাইছিলাম, ও কোনও একটা বই পছন্দ করুক। দেখলাম, এটা–‌সেটা নেড়েচেড়ে দেখছে। শেষমেশ লীলা মজুমদার আর অন্নদাশঙ্কর রায়ের বই পছন্দ হল। অন্য একটা স্টলে গিয়ে ভ্রমণের ওপর একটা বই কিনতে চাইল। আরও একটা স্টলে গিয়ে খেলার দুটো বই। ফাঁকে ফাঁকে আমিও টুকটাক কিছু কিনে ফেললাম। আমার প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ। তাঁর প্রায় সব বই–‌ই পড়া। তবু বইমেলায় নতুন নতুন আঙ্গিকে বিভিন্ন প্রকাশক বিভূতিভূষণকে হাজির করেন। সেগুলো কিনব না!‌ নতুন বই না হয় আরও একবার পড়ব!‌ তাছাড়া, আমি অনেককেই বই উপহার দিই। কাউকে না হয় উপহার হিসেবেই দেওয়া যাবে।

সেলিব্রিটি দর্শনও কম হল না। আমি আবার সবাইকে ঠিকঠাক চিনি না। নাতি দেখলাম, অনেককেই চিনতে পারল। কয়েকজনের কাছে গিয়ে সেলফিও তুলল। সে তুলুক। ওর কাছে এই স্মৃতিটা থেকে যাবে। তাছাড়া, ঘরে থাকলে কীই বা করত!‌ তার থেকে বইমেলার এই ভিড়, এই বইয়ের সমুদ্র দেখা অনেক ভাল।

না, আমরা দাদু–‌নাতি কুম্ভের উন্মাদনায় মাতিনি। আমরা গিয়েছিলাম বইমেলায়। হ্যাঁ, এটাই আমাদের প্রতিবাদ।
‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.