ময়ূখ নস্কর
ইংরাজিতে একটা প্রবাদ আছে। speech is silver, but silence is golden . অর্থাৎ, বক্তৃতার থেকে নীরবতার মূল্য অনেক বেশি। বক্তৃতা যদি রুপো হয়, নীরবতা হল সোনা।
ইংরেজরা এই প্রবাদ মানে কিনা জানি না। ভারতীয়রা একেবারেই মানে না। ভারতে যুগ যুগ ধরে বক্তৃতার ছড়াছড়ি, বাণীর ছড়াছড়ি। এ দেশের ধর্মগুরু, স্বাধীনতা সংগ্রামী, শিল্পী-সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক, রাজনৈতিক নেতা, বিগ অভিনেতা, লিটল ক্রিকেটার—সবাই বাণী কুমার। কাজের লোক খুবই কম।
এঁদের সমালোচনা করছি না। এঁরা বাকসর্বস্ব, তাও বলছি না। কিন্তু এঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে গোটা জাতি বাক্যবাগীশ হয়ে উঠেছে। সকলেই কিছু না পারুক, বক্তৃতা ঝাড়তে পারে। speech is silver. বক্তৃতার রুপোয় দেশ ঝকঝক করছে। আজকাল সোশাল মিডিয়া এবং টিভি চ্যানেলের যুগে সেই রুপোও আর রুপো নেই, অ্যালুমিনিয়াম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অলিম্পিকে কথা বলার কম্পিটিশন থাকলে ভারত একের পর এক সোনা পেত।
কিন্তু silence is golden . সেই হিরন্ময় নীরবতার বড় অভাব এই দেশে। নীরবে নিজের কাজ করেন, তেমন কেউ আছেন? কাউকে দেখাতে পারেন? এক ছিলেন বিদ্যাসাগর (বাকিরা অধিকাংশই কথার সাগর)। আর ছিলেন গান্ধীজি। যিনি বলেছিলেন, আমার জীবনই আমার বাণী (বাকিদের কাছে আমার বাণীই আমার জীবন)। তার পরে আছেন মনমোহন সিং।
না, নাম শুনে চমকে উঠবেন না। তাঁকে বিদ্যাসগর, গান্ধীজির সঙ্গে এক আসনে বসাচ্ছি না। তিনি ভাল না মন্দ, সেই বিতর্কেও ঢুকছি না। শুধু বলছি তাঁর নীরবতার কথা। আর বলছি ঘটনাচক্রে তাঁর আর বিদ্যাসাগরের জন্মদিন একই (২৬ সেপ্টেম্বর)। এবং গান্ধীজির মতোই তাঁর নামেও মোহন শব্দটি আছে।
বিশ্বের প্রথমসারির অর্থনীতিবিদ, নামজাদা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ভারতের দশ বছরের প্রধানমন্ত্রী, তারও আগে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর। তিনি বক্তৃতাবাজ হলে বেমানান হত না। কারণ, তিনি বিদ্বান। তিনি বিনয়ী। কারণ, বিদ্যা বিনয় দান করে।
মনমোহন সিংয়ের আগে ছিলেন এক বাণী কুমার। পরে এসেছেন এক বুকনিবাজ। শুধু কেন্দ্রে নয়, রাজ্যে রাজ্যে, পুরসভায় পুরসভায়, পঞ্চায়েতে পঞ্চায়েতে, টিভিটে টিভিতে শুধুই বুকনি, শুধুই বক্তৃতা। কাক চড়াইয়ের এই কিচির মিচিরের মধ্যে জ্ঞানী প্যাঁচার মতোই মিতভাষী মনমোহন সিং। তাঁর আর্থিক নীতি আজ সমস্ত সরকার অনুসরণ করে। তাঁর বিদেশনীতি, তাঁর জিএসটি, তাঁর পরমাণু চুক্তি, খাদ্যসুরক্ষা, একশো দিনের কাজ। সবকিছুর ক্ষির খায় অন্য সরকার। আর তাঁকে বলে নিকম্মা। তিনি একদিনও প্রতিবাদ করেন না। কারণ, silence is golden .
তাঁকে অপছন্দ করতে পারেন। অপদার্থ বলতে পারেন। নিকম্মাও বলতে পারেন। কিন্তু silence Is golden. তাঁর নীরবতাকে সম্মান করুন। পারলে অনুসরণ করুন। তাঁর মৃত্যুর পর শোক জানানোর যে ঘটা, যেভাবে সবাই ভাষণ দিয়ে চলেছেন, বোঝাই যাচ্ছে, তাঁরা মনমনোহন সিংকে আদৌ চেনেননি।