শুধু শরিকদের ঘাড়ে দায় চাপালে যন্ত্রণা মিটবে তো!‌

রক্তিম মিত্র

যত রাগ গিয়ে পড়ছে ফরওয়ার্ড ব্লক আর আরএসপি–‌র ওপর। কেন যে সিতাই আসনটা ফরওয়ার্ড ব্লককে ছাড়া হল?‌ কেন যে মাদারিহাট আসনটা আরএসপি–‌কে ছাড়া হল?‌ ফেসবুকে এমন মন্তব্যের ছড়াছড়ি। নির্যাসটা হল, ওই দুই আসনে সিপিএম দাঁড়ালেই ড্যাং ড্যাং করে জিতে যেত।

ফেসবুক সর্বস্ব রাজনৈতিক বোদ্ধাদের নিয়ে এই এক মুশকিল। তাঁরা ভোটের আগে ভেবে নেন, সব আসনেই বোধ হয় সিপিএম জিতে যাবে। আর ভোট পেরোলে যখন রূঢ় বাস্তবটা সামনে আসে, সেটাকে হজম করতে পারেন না। উপনির্বাচনের ফল কী হবে, তা কি জানা ছিল না?‌ কোনও আসনেই বামেদের যে ন্যূনতম দ্বিতীয় হওয়ার সম্ভাবনাটুকুও নেই, কোথাও অনেক পিছিয়ে থেকে তৃতীয়, কোথাও চতুর্থ — এই দেওয়াল লিখন কি পড়তে পারেননি?‌

কেন সিপিএম শরিকদের আসন ছাড়ে?‌ কেন এদের ঘাড় ধরে বামফ্রন্ট থেকে বের করে দেওয়া হয় না, মোটামুটি এমন মন্তব্যে ফেসবুকের দেওয়াল ছেয়ে যায়। এবং এই জাতীয় মন্তব্য যে বিক্ষিপ্তভাবে এক–‌দুজন করেন, এমন নয়। কোনও কোনও পোস্টের নিচে কমেন্ট বক্সে তাকালে মনে হয়, এই মনোভাবটাই যেন মূলস্রোত হয়ে উঠেছে। এই চেতনা নিয়ে এঁরা বামফ্রন্টের মিছিল করেন!‌ এই রাজনৈতিক বোধ নিয়ে এঁরা বাম আন্দোলনকে শক্তিশালী করার স্বপ্ন দেখেন!‌

ফেবু পন্থী বিরাট অংশের বামেদের ধারণা, শরিকদের কোথাও কোনও সংগঠন নেই। বছরের পর বছর সিপিএম তাদের জিতিয়ে আসে। আর এই শরিকরা তৃণমূলের হয়েই কাজ করেন। আগে বলা হত, ক্ষমতার ভাগ নিতেই এরা বামফ্রন্টে রয়েছেন। আর যখন তের বছর, বামেরা ক্ষমতা থেকে বহুদূরে, তখন বলা হয়, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তাই পড়ে আছেন।

এটা ঘটনা, শরিকদের বেশ কিছু আসনে জয়ের পেছনে সিপিএমের ভূমিকাই প্রধান। সিপিএম আশি, তো শরিকরা হয়তো কুড়ি। কিন্তু সব জায়গার চিত্রটা এমন নয়। কোচবিহারে ফরওয়ার্ড ব্লকের শক্তি বা চা–‌বলয়ে আরএসপির সাংগঠনিক শক্তি কতখানি, তা কলকাতায় বসে বোঝার কথা নয়। সাতের দশক বা আটের দশকের কথা নয়। সাম্প্রতিক অতীতেও বহুবার তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২০১১–‌র কথাই ধরা যাক। রাজ্যে এত পরিবর্তনের ঝড়ের মাঝেও কোচবিহারে চারটি আসনে জিতেছিল ফরওয়ার্ড ব্লক। আসনগুলি হল কোচবিহার উত্তর, কোচবিহার দক্ষিণ, দিনহাটা, মেখলিগঞ্জ। সিতাই অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়। আর সেই জেলায় সিপিএমের চিত্রটা একটু দেখা যাক। মাথাভাঙা, শীতলকুচি, নাটাবাড়ি, তুফানগঞ্জ। এই চারটি আসনই সেই সাতাত্তর থেকে জিতে আসছে সিপিএম। কিন্তু চারটি আসনেই হারতে হয়েছে ২০১১ তে। এমনকী, ২০১৬ তে তা পুনরুদ্ধার করাও যায়নি। ফরওয়ার্ড ব্লক যে চারটি আসনে জিতেছিল, তা কি একক কৃতিত্বে?‌ মোটেই না। অবশ্যই সিপিএমের ভূমিকা ছিল। কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লকের সাংগঠনিক ভিত্তি জোরালো ছিল বলেই দুই শক্তির মিলিত চেষ্টায় জয় এসেছে। অন্যদিকে, সিপিএমের একক শক্তি তেমন জোরালো হলে মাথাভাঙা, শীতলকুচি, নাটাবাড়ি বা তুফানগঞ্জে হারতে হত না।

অনুরূপভাবে আলিপুরদুয়ার। চা–‌বাগান এলাকায় আরএসপি–‌র ভিত্তি বরাবরই মজবুত। সেই কারণেই ২০১১ তেও কুমারগ্রাম, মাদারিহাটে আরএসপি জয়ী হয়। এই জয়ের ক্ষেত্রেও সিপিএমের ভূমিকা অবশ্যই ছিল। কিন্তু এই দুই জায়গাতেই আরএসপি–‌র শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল। দুই দলের শক্তি যোগ হয়েছে বলেই জয় এসেছে। এমনকী, কালচিনি বা আলিপুরদুয়ারেও লড়াই দেওয়া গেছে।

গোটা বাংলায় এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। যেখানে শরিকেরা সিপিএমের ঘাড়ে চড়ে জিতত, সেসব জায়গায় কিন্তু হারতে হয়েছে। আর ফিরিয়ে আনাও যায়নি (‌যেমন, বরানগর, বোলপুর ইত্যাদি)‌। কিন্তু যেখানে সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল, সেখানে ১১ তে হারলেও ১৬ তে আবার সেই আসন ফিরিয়ে আনা গেছে (‌যেমন, বালুরঘাট, ছাতনা)‌।

এটা ঘটনা, সিতাই বা মাদারিহাটে এবার বাম শরিকরা খুবই কম ভোট পেয়েছেন। ধরেই নিলাম, সেই এলাকায় শরিকদের পায়ের তলায় মাটি নেই। কিন্তু সিপিএমের ভোট গেল কোথায়?‌ ফব প্রার্থী চার হাজার ভোট পাচ্ছেন মানে তো সেটা সিপিএম আর ফব মিলিয়ে। অর্থাৎ, সিপিএমের ভোট হয় চার হাজারেরও কম অথবা, সেই ভোট হয় তৃণমূলে নয়তো বিজেপিতে পড়েছে। এটা কি সিপিএমের পক্ষেও খুব গৌরবজনক!‌

নৈহাটি তে লিবারেশন বা হাড়োয়ায় আইএসএফকে না ছাড়লেই বা ফল কী হত?‌ বিরাট কিছু হেরফের হত কি?‌ কয়েকমাস আগে হওয়া লোকসভা ভোটের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। বসিরহাটে সিপিএম প্রার্থীর থেকে আইএসএফ অনেক বেশি ভোট পেয়েছিল, এটা ঘটনা। শুধু তালডাংরার ফল দেখিয়ে বিরাট উন্নতি হয়েছে, ভাবার কোনও কারণ নেই। কমাস আগের লোকসভা বলুন বা ২০১৯ এর লোকসভাই বলুন, তালডাংরায় মোটামুটি এরকম ভোটই এসেছিল।

যাই হোক, মোদ্দা কথা তাহলে কী দাঁড়াল। সহজ কথা, এখন তৃতীয় বা চতুর্থ হওয়াই ভবিতব্য। এটাই নির্মম বাস্তবতা। শরিকদের কাঠগড়ায় তুললে শূন্যের যন্ত্রণা কাটবে না। যেদিন সিপিএমের পালে হাওয়া লাগবে, শরিকদের পালেও হাওয়া লাগবে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *