বাড়িতে একটাও পুজো সংখ্যা নিয়েছেন!!

সৃজন শীল

শিক্ষিত বাঙালির জীবনে পুজোর এক অনিবার্য অনুষঙ্গ ছিল পুজো সংখ্যা। যে কোনও বাড়িতেই যান, একটা বা দুটো পুজো সংখ্যা চোখে পড়ত। এবং সেই বইগুলি নিছক লোককে দেখানোর জন্য নয়, বাড়ির অনেকেই যে যার পছন্দমতো বিষয় পড়তেন। কেউ পড়তেন উপন্যাস, কেউ গল্প। কেউ আবার পড়তেন বিভিন্ন ছোট ছোট ফিচার।

গত কয়েক বছরে মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির চেহারাটাই যেন বদলে গেছে। বাড়িতে দামি দামি আসবাব বা উপকরণের অভাব নেই। অনেক বাড়িতেই উঁকি মারছে এসি মেশিন। হাতের ফোনটাও হয়তো তিরিশ হাজার টাকার। কিন্তু হারিয়ে গেছে ওই পুজো সংখ্যা। এখনও জুলাই, আগস্ট থেকেই বিভিন্ন প্রকাশনার পুজো সংখ্যা বেরোতে শুরু করে। কাগজে ঘটা করে তার বিজ্ঞাপনও হয়। কিন্তু অধিকাংশ বাড়িতেই এখন আর পুজো সংখ্যা ঠাঁই পায় না।

হয়তো অনেকে বলবেন, যদি লোকে নাই কিনবে, তাহলে ছাপা হচ্ছে কেন?‌ নিশ্চয় বিক্রি হচ্ছে। হ্যাঁ, হচ্ছে। কিন্তু আপনার পরিচিত কজনের বাড়িতে আগে পুজো সংখ্যা নেওয়া হত আর এখন কজনের বাড়িতে নেওয়া হয়, একটু খোঁজ নিন। তাহলেই ছবিটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। পাঁচটা–‌ছটা পুজো সংখ্যা নিতে বলছি না। কিন্তু বছরে একটা পুজো সংখ্যা বাড়িতে নেওয়া যায় না!‌

যদিও বা নেওয়া হয়, সেখান থেকে নিদেনপক্ষে একটা উপন্যাস কজন পড়েছেন, সেই হিসেব কষতে গেলে সত্যিই আপনাকে হতাশ হতে হবে। আসলে, টানা দশ পাতা পড়ার মতো ধৈর্যটাই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। অনেকে হয়তো বলবেন, দিনদিন ব্যস্ততা বাড়ছে। এখন আর আগের মতো সময় থাকে না। আমার মনে হয়, এর থেকে ডাঁহা মিথ্যে আর কিছু হতে পারে না। যিনি ব্যস্ততার অজুহাত দিচ্ছেন, তিনি কিন্তু ফেসবুকে দিনে পাঁচ–‌ছয় ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় কাটাচ্ছেন। সারাদিন ফোনের সান্নিধ্যে সাত–‌আট ঘণ্টা কেটে যায়। টানা দশ মিনিট ফোন ছাড়া থাকতে বলুন। মনে হবে, অক্সিজেন ছাড়া যেন জলে ডুব দিয়ে আছে। সবকিছুর জন্য সময় আছে। শুধু পড়ার জন্যই সময় নেই।

অথচ, এই সহজ সত্যিটা স্বীকার করার মতো সততাও নেই। একবার শুধু জানতে চান, শেষ দশ বছরে কোন বই পড়েছেন?‌ স্পষ্ট উত্তর পাবেন না। সেই ছোটবেলায় কী পড়েছেন, তার ফিরিস্তি শুনবেন। যাবতীয় পড়াশোনা যেন কুড়ি–‌তিরিশ বছর আগেই ফেলে এসেছেন। গত কুড়ি বছরে লেখা হয়েছে, এমন বইয়ের নামও শুনতে পাবেন না। কেউ কেউ আন্দাজে বলবেন, কাকাবাবু পড়তাম। জিজ্ঞেস করুন, কোথায় বেরোতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুল উত্তর পাবেন। মোদ্দা কথা, অধিকাংশ লোকের সঙ্গে কথা বলে এটুকু বুঝতে পারি, গত পাঁচ বছরে তিনি একটি বইও পড়েননি। এমনকী গত পাঁচ বছর হয়তো কোনও পুজো সংখ্যাও কেনেননি। কেউ কেউ করোনার উদাহরণ টানেন। যেন, করোনার আগে তিনি পড়ে একেবারে ফাটিয়ে দিতেন। নেহাত করোনা চলে এল। বইয়ের মধ্যে দিয়ে জীবাণু আসে। তাই তিনি পড়া বন্ধ করেছেন।

এইসব আজগুবি ব্যাখ্যা যখন শুনি, সত্যিই খুব রাগ হয়। সবার কাছে নিশ্চয় সমান প্রত্যাশা থাকে না। কিন্তু যিনি হাইস্কুলে বা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন, বা যিনি কলেজে পড়ান, তাঁদের কাছে তো ন্যূনতম কিছু প্রত্যাশা থাকে। অন্তত তাঁরা বছরে একটা বই কিনবেন বা পড়বেন, এটুকু তো আশা করা যায়। কিন্তু তাঁদেরও অধিকাংশই সিলেবাসের বাইরে কোনও বই গত পাঁচ বছরে কেনেননি বা পড়েননি।

হয়তো কথাগুলো বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হবে। মনে হবে, একটু বেশিই বোধ হয় সমালোচনা করছি। বেশ, আপনি আপনার পরিচিত মহলে সমীক্ষা করুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন। খোঁজ নিয়ে দেখুন তো, আপনার কজন পরিচিত লোকের বাড়িতে পুজো সংখ্যা নেওয়া হয়, তাহলেই বুঝতে পারবেন। আসলে, আমরা টানা দশ পাতা পড়ার মতো ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছি। আর এই সহজ সত্যিটা এখনও বুঝে উঠতেই পারিনি।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.