ধীমান সাহা
দেশের মাটিতে ভারত হল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। যাকে পাবে, তাকেই হারিয়ে দেবে। কিন্তু বিদেশে গেলেই যেন নেংটি ইঁদুর। সেখানে আবার যার–তার কাছে হেরে যাবে। মোটামুটি এটাই ছিল দস্তুর। একসময় অধিনায়ক হিসেবে মহম্মদ আজহারউদ্দিনের ট্র্যাক রেকর্ড ছিল ঈর্ষণীয়। হবে নাই বা কেন? হিরওয়ানি, আর্শাদ আইয়ুবদের জমানা পেরিয়ে এসে গেল অনিল কুম্বলে, বেঙ্কটপতি রাজুদের জমানা। ঘরের মাটিতে সে ওয়েস্ট ইন্ডিজই হোক বা ইংল্যান্ড, ভারত সাড়ে তিনদিন বা চারদিনেই তাদের নটেগাছ মুড়িয়ে দেবে।
বেদি, প্রসন্ন, চন্দ্রশেখর, বেঙ্কটরাঘবনদের তুলনায় আর্শাদ আইয়ুব বা রাজেশ চৌহানরা নেহাতই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। কিন্তু সেই আমলে অর্ডার দিয়ে বানানো এমন ঘূর্ণি উইকেট ছিল না। তাই সারস যেভাবে শেয়ালকে বা শেয়াল যেভাবে সারসকে নেমন্তন্ন করে বেইজ্জত করেছিল, সেই প্রথা ছিল না। তখন ভারত বেশ অতিথি পরায়ণ ছিল। নয়ের দশকের পর থেকেই শুরু হল অন্য খেলা। বিদেশিদের ডেকে আনো, ঘাড় ধরে ঘূর্ণি পিচে ফেলে দাও। তারপর তুর্কিনাচন দেখতে থাকো। কখনও এই তুর্কি নাচন দেখিয়েছেন হিরওয়ানি–আইয়ুবরা। কখনও কুম্বলে–রাজু। কখনও কুম্বলে–হরভজন। কখনও অশ্বিন, কুলদীপ, চাহালরা।
কিন্তু এখন সেটাই যেন বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুনেতে টার্নিং উইকেট বানানো হল ওয়াশিংটন সুন্দর, রবীন্দ্র জাদেজাদের জন্য। সুন্দর দশ উইকেটের গন্ডি পেরোলেন ঠিকই, কিন্তু আসল বাজিমাত করে গেলেন মিচেল স্যান্টনার। অন্যের জন্য খুঁড়ে রাখা গর্তে নিজেদেরই পড়তে হল। আড়াই দিনেই যবনিকা। বেঙ্গালুরু টেস্টেও হারতে হয়েছে আরও শোচনীয়ভাবে। গত বারো বছরে ঘরের মাটিতে ভারত সিরিজ হারেনি। সেখানে টানা দুই ম্যাচে কিনা হারতে হল, তাও আবার নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে! সত্যিই হজম হওয়া বেশ কঠিন।
ভারতে কি তবে স্পিনারের আকাল পড়েছে? তাই বা বলি কী করে? অশ্বিনের পাঁচশোর ওপর উইকেট। এখনও যে কোনওদিন বিপক্ষকে কুপোকাত করতে পারেন। যে কোনও ব্যাটিং লাইন আপ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে পারে। কুলদীপ যাদব, ওয়াশিংটন সুন্দর বা রবীন্দ্র জাদেজাও নেহাত মন্দ স্পিনার নন। নিজের নিজের দিনে এঁরাও একাই ফারাক গড়ে দিতে পারেন। তাহলে, মোদ্দা কথাটা কী দাঁড়াল? সহজ সত্যিটা মেনে নেওয়াই ভাল, আমাদের ব্যাটসম্যানরা আগের মতো স্পিন খেলতে পারছেন না।
বিরাট কোহলি, যতই রান বা শতরান থাক, নিজের সেরা ফর্মকে ফেলে এসেছেন। স্পিনের বিরুদ্ধে বরাবারই দুর্বল। সেটা যত দিন যাচ্ছে, আরও প্রকট হচ্ছে। আগ্রাসনটা আচরণে আছে ঠিকই, কিন্তু ব্যাট হাতে যেন অনেকটাই গুটিয়ে। সন্তর্পণে কোনওরকমে পঞ্চাশ পেরোতে হবে, এটাই যেন মাথায় ঢুকে গেছে। ফলে, বোলাররা মাথায় চড়ে বসছে। আবার শেষমেশ বড় রানও আসছে না।
রোহিত শর্মার কথাই ধরুন। একদিনের ক্রিকেটে বা টি২০ তে শুরুতে ঝড় তোলায় এখনও দারুণ পারদর্শী। কিন্তু যেখানে লম্বা ইনিংস গড়তে হবে, সেখানে যেন হঠকারিতা দেখা যাচ্ছে। অধিনায়কত্বের বাড়তি চাপ তো আছেই। ক্যাপ্টেন শব্দটার মধ্যে গ্ল্যামার যেমন আছে, বাড়তি বোঝাও কম নেই। কত প্রাণবন্ত মানুষ এই চাপের কাছে গুটিয়ে গেলেন। শেহবাগের ঘাড়ে যদি নেতৃত্বের বোঝা এসে যেত, তাহলে কি কিশোর কুমারের গান গাইতে গাইতে এভাবে ‘বল্লা ঘুমাকর’ মারতে পারতেন? সারসত্যটা শচীন বুঝেছিলেন, তাই ২০০০ সালে সেই যে নেতৃত্ব ছেড়েছেন, আর ওই মুকুট পরার চেষ্টাই করেননি। যতবার আর্জি এসেছে, সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
ইনিংস গড়তে পারতেন চেতেশ্বর পুজারা বা অজিঙ্ক রাহানে। কিন্তু তাঁদের কার্যত নিষ্ফল, হতাশের দলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা পৌঁছে গেছেন অবসরের চৌকাঠে। এই তো সেদিন, রনজি ট্রফিতে আড়াইশোর ওপর রান করলেন পুজারা। কিন্তু জাতীয় দলের দরজা যে আর খুলবে না, এই নির্মম দেওয়াল লিখনটা নিশ্চয় পড়তে পারছেন। যশস্বী জয়সওয়াল এক ক্যালেন্ডারে হাজারের ওপর রান করে ফেললেন। একটা সিরিজে করেছিলেন ৭১১ রান। কিন্তু স্পিনের বিরুদ্ধে তিনিও তেমন সড়গড় নন। সরফরাজ খান। ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে সফল। তাঁর সঙ্গে কিছুটা অবিচারই হয়েছে। জাতীয় দলের দরজাটা অনেক দেরিতেই খুলেছে। সিরিজে শতরানও পেলেন। কিন্তু আসল সময়ে দাঁড়াতে পারলেন না। ঋষভ পন্থ। দারুণভাবে ফিরে এসেছেন। লাল বলেও সেই চেনা দাপট। কিন্তু স্পিন খেলতে গেলে যে ধৈর্য ও সংযম লাগে, তার কোথায় একটা ঘাটতি রয়েছে।
আইপিএল যেমন অনেককিছু দিয়েছে, তেমনই অনেককিছু কেড়েও নিয়েছে। নতুন নতুন তারকার জন্ম দিয়েছে। বাণিজ্য দিয়েছে। বিশ্ব ক্রিকেটে দাদাগিরির অধিকার এনে দিয়েছে। কিন্তু স্পিনার সামলানোর ধৈর্য কেড়ে নিয়েছে। তাই টেস্ট থেকে ড্র শব্দটা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। এমনকী অধিকাংশ টেস্ট তিনদিনে বা সাড়ে তিন দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এরপর কি ভারত জিতবে না? দেখুন হয়তো অস্ট্রেলিয়া সফরেই জিতে গেল। হয়তো পেসাররা দাপট নিয়ে জেতালেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার কোনও আনকোরা স্পিনারের বলে যদি গুটিয়ে যায়, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আসল কথা, আমাদের স্পিনারের অভাব নেই। কিন্তু স্পিন খেলার লোক বড় কম পড়িয়াছে।