স্বরূপ গোস্বামী
সত্যিই অদ্ভুত একটা সমাজে আমরা বাস করি। আমরা নিজেরা ঘরে বসে থাকি। ফেসবুকে বিপ্লব করি। আর যদি কেউ রাস্তায় নেমে দিন রাত তাঁদের মতো করে লড়াই করেন, তখন সেই লড়াই কেমন হওয়া উচিত, তাই নিয়ে জ্ঞান দিই।
জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন প্রত্যাহার হয়েছে। ব্যস, এবার জ্ঞান দেওয়া শুরু হয়ে গেল। তাঁদের এই করা উচিত ছিল। তাঁদের ওই করা উচিত হয়নি। ইত্যাদি ইত্যাদি।
চিকিৎসকরা তাঁদের মতো করে আন্দোলন করেছেন। তাঁরা আন্দোলনকে জোরদার করতে কোনও রাজনৈতিক দলের সাহায্য চাননি। তাঁদের কাছ থেকে অর্থও চাননি। জমায়েত করার লোকও চাননি। বরং হাতজোড় করে অনুরোধ করেছেন, সক্রিয় রাজনীতি করেন, এমন কেউ আমাদের মঞ্চে আসবেন না। আমাদেরকে আমাদের মতো করেই আন্দোলন করতে দিন। এবং তাঁরা প্রায় আড়াই মাস ধরে আন্দোলন করে দেখিয়ে দিয়েছেন।
এখন টানা হ্যাঁচড়া শুরু হয়েছে, তাঁরা কোথা থেকে এত অর্থ পেলেন? তাঁদের অ্যাকাউন্টে কীভাবে চার কোটি টাকা উঠে এল? এই নিয়ে শাসক দল তো প্রকাশ্যেই প্রশ্ন তুলছে। মিডিয়াও তুলছে। অন্যান্য বিরোধীরাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।
ডাক্তাররা মাত্র কদিন আন্দোলন করছেন, এর মধ্যেই তাঁদের অ্যাকাউন্টে এত টাকা এল কীভাবে, এই নিয়ে অন্যদের চিন্তার শেষ নেই। আসলে, ডাক্তারদের আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা এই স্তরে পৌঁছে গেছে, এই ব্যাপারটা অনেকের বোধ হয় হজম হচ্ছে না। আসলে, সৎ কাজে টাকা দেওয়ার মতো মানুষ এখনও আছেন। এটাই আবার প্রমাণিত।
এই ডাক্তারদের কারা টাকা দিয়েছেন? বেশিরভাগটাই অনলাইনে দেওয়া নেওয়া হয়েছে। সরকার বা আয়কর দপ্তর চাইলেই তদন্ত করে দেখে নিতে পারেন। যাঁরা দিয়েছেন, তাঁদেরও গোপন করার কিছু নেই। ডাক্তাররাও সব হিসেব দিতে তৈরি। রাজনৈতিক দলগুলির এই স্বছতা আছে?
প্রথমত, এই ডাক্তাররা সরকার চালান না। এঁদের কাছ থেকে ভবিষ্যতে পাওয়ার কিছুই নেই। তারপরেও মানুষ কেন দিচ্ছেন? এই প্রশ্নটা কেউ ভেবে দেখেছেন? যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশই এঁদের চেনেনও না। এঁরাও তাঁদের চেনেন না। কিন্তু তারপরেও ভিন রাজ্যের এমনকী ভিন দেশের মানুষরা টাকা দিতে চাইছেন। কেন? টাকা দিয়ে তাঁদের কী লাভ? আসলে, এঁদের আন্দোলন কোথাও একটা এমন স্তরে পৌঁছেছে, যেখানে মানুষের মনে হচ্ছে, এঁদের পাশে থাকা দরকার। মানুষের কোথাও একটা মনে হচ্ছে, এঁদের লড়াইয়ে আমার এটুকু অন্তত অবদান থাকুক। দিয়ে তিনি নিজেও কোথাও একটা মানসিকভাবে তৃপ্তি পাচ্ছেন।
এই বিশ্বাসযোগ্যতটা অন্যদের নেই কেন, সেটা একবার ভেবে দেখুন। কাল যদি তৃণমূল কোনও একটা বিষয়ে টাকা তুলতে চায়, হয়তো এর একশো গুন টাকা উঠবে। কিন্তু যাঁরা দেবেন, তাঁরা আসলে কারা? সেই তো ঠিকাদার, প্রোমোটার, ফড়ে ব্যবসায়ী। জোর করে আদায় করতে বেরোলে ভয়ে হয়তো অনেকে দেবেন। কিন্তু স্বেচ্ছায় কজন সাধারণ মানুষ টাকা দেবেন? কেউ দেবেন খুশি করতে, কেউ দেবেন ভয়ে, কেউ দেবেন ভবিষ্যতে কিছু পাওয়ার আশায়। এর বাইরে চার কোটি কেন, চার লাখ তোলাও কঠিন। কিন্তু ডাক্তারদের চাঁদা দেওয়ার ক্ষেত্রে খুশি করা, ভয় পাওয়া বা ভবিষ্যতে কোনও টেন্ডার বা পদ পাওয়ার আশা— এসব কিছুই ছিল না। ছিল নিখাদ ভালবাসা। ছিল নিখাদ বিশ্বাস।
তাই, কেন তাঁরা না চাইতেও এত টাকা উঠে যাচ্ছে, এটা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে বরং ভাবুন, আপনারা চাইলেও কেন উঠছে না।
ভাবুন, ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন।