অভিরূপ অধিকারী
আমার জন্ম তেলেগু ব্রাহ্মণ পরিবারে। আমি জন্মেছি চেন্নাইয়ে। তারপরই আমি চলে আসি হায়দরাবাদে। তখন সদ্য দেশ স্বাধীন হয়েছে। হায়দরাবাদে তখনও কার্যত নিজামি শাসন। আমার পড়াশোনা মুসলিম আবহে। তারপর আমি চলে আসি দিল্লিতে। যাঁর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে, তাঁর বাবা ছিলেন সুফি সম্প্রদায়ের। মা রাজপুত, কিন্তু থাকতেন মাইশোরে। আমার যে সন্তান, তাকে কী বলবেন? সে কি তেলেগু? সে কি ব্রাহ্মণ? সে কি হিন্দু? সে কি মুসলিম? কোন পরিচয়ে তাকে পরিচিত করবেন? তার পরিচয় একটাই, সে ভারতীয়। ভারতীয় ছাড়া আর কোন নামে তাকে ডাকা যায়! সংসদে নিজের বিদায়ী ভাষণে এভাবেই ভারতের বহুত্ববাদকে তুলে ধরেছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি।
তাঁর জীবনেও যেন কত ভিন্ন সত্তার স্রোত। হিন্দি, ইংরাজি, উর্দু— এই তিনটে ভাষাই গড়গড় করে বলে যেতে পারতেন। এই পর্যন্ত হলে তেমন অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। কিন্তু ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের সঙ্গে কথা বলছেন মালয়ালমে, বাসবপুন্নাইয়ার সঙ্গে বলছেন তেলেগুতে। হরকিষেন সিং সুরজিতের সঙ্গে পাঞ্জাবিতে। আর জ্যোতি বসুর সঙ্গে বাংলায়। একই মঞ্চে দলের চার শীর্ষ নেতার সঙ্গে তাঁদের রাজ্যের ভাষায় কথা বলছিলেন। তাঁর বয়স তখন কত? হয়তো তিরিশ আর চল্লিশের মাঝে ঘোরাফেরা করছেন। যে চারজন নেতার কথা বলা হল, সবারই বয়স তাঁর দ্বিগুনেরও বেশি। পলিটব্যুরোর চার প্রবীণ নেতা। অথচ, তাঁদের যোগসূত্র কিনা মাঝ তিরিশের এই ছোকরা। জ্যোতি বসু মজা করে সুরজিৎকে বলে বসলেন, ‘এই ছেলের থেকে সাবধানে থাকতে হবে। খুবই ভয়ঙ্কর।’ সুরজিৎ প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। জ্যোতিবাবু বুঝিয়ে দিলেন, ‘আমরা কেউ কারও কথা বুঝতে পারছি না। কিন্তু এই ছোকরা আমাদের সবার কথা বুঝে ফেলছে।’ যে জ্যোতিবাবুর হাসি ছিল বিরল, তিনিও কথাগুলো বলে হেসেই ফেললেন। স্নেহের হাসি, প্রশ্রয়ের হাসি।
বলা হয়, সিপিএমে নাকি বৃদ্ধতন্ত্রের জয়জয়কার। গোদা বাংলায় বললে, সিপিএম বুড়ো হাবড়াদের পার্টি। ঘটনা হল, এই সীতারাম ইয়েচুরি রাজ্য কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটির পর্ব পেরিয়ে পলিটব্যুরোতে এসেছিলেন মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে। তাও এমন এক সময়ে যখন পলিটব্যুরোর নবরত্নের প্রায় সবাই বেশ সক্রিয়।
রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হয়নি। ফলে, উত্তরাধিকারের ট্যাগলাইন ছিল না। যে মানুষটা এত অল্প বয়সে পলিটব্যুরোয় এলেন, তিনি কিন্তু তার আগে পর্যন্ত বিধায়ক বা সাংসদ হননি। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি ছেড়ে হয়ে গেলেন ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র পার্টি হোলটাইমার। মজা করে বলতেন, ‘আমার স্ত্রী আমাকে পোষেন। আর আমি বিপ্লব করে বেড়াই।’ পাণ্ডিত্য আর রসবোধ বোধ হয় এভাবেই হাত ধরাধরি করে হাঁটে। রাজ্যসভায় গেছেন ঠিকই, কিন্তু বয়স হাফসেঞ্চুরি পেরিয়ে যাওয়ার পর। কিন্তু তারপরও কী দুরন্ত ইনিংস। কখনও ধ্রুপদি কভার ড্রাইভ, তো কখনও স্টেপ আউট করে ছক্কা। বল হাতেও কখনও হিমশিম খাইয়ে দেওয়া সুইং, তো কখনও ভড়কে দেওয়া গুগলি। সন্ত্রাসবাদ হোক বা বহুত্ববাদ। অর্থনৈতিক সংস্কার হোক বা শিক্ষার বেসরকারিকরণ। প্রাচীন পরম্পরা হোক বা তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব। যে কোনও পিচে ব্যাট করতে নামিয়ে দিন। ঠিক সেঞ্চুরি করে বেরিয়ে আসবেন। চিৎকার করতে হয়নি, হল্লাবাজি করতে হয়নি। আসলে, যুক্তির জোর মজবুত হলে গলার জোরের তেমন দরকার পড়ে না। কখনও দৃপ্ত কণ্ঠে সংসদকে আয়না দেখাচ্ছেন, আবার কখনও সেন্স অফ হিউমারের দুরন্ত প্রয়োগ। কথায় আছে, স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে। তাই প্রধানমন্ত্রী বলতে উঠলে তাঁকে মনে হয়েছে নিছক একটি দলের নেতা। আর সীতারাম ইয়েচুরি বলতে উঠলে মনে হয়েছে, দেশের বিবেক। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা স্তাবককূলের টেবিল বাজানোর আওয়াজে হারিয়ে যায়। আর সীতারামের কণ্ঠ মুগ্ধতার নৈঃশব্দ ভেদ করে হৃদয়ে পৌঁছে যায়।
আর সংসদের বাইরে সমন্বয়! নয়ের দশকে এই দায়িত্বটা মূলত সামলাতেন হরকিষেন সিং সুরজিৎ। ইউপিএ ওয়ান থেকে এই দায়িত্বটা অনেকটাই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন প্রকাশ কারাত–সীতারাম ইয়েচুরি। একশো দিনের কাজ হোক, খাদ্যসুরক্ষা বা তথ্যের অধিকার হোক। সরকারে বামেরা না থাকলেও সরকারকে রাজি করানোর বড় দায়িত্বটা নিতে হয়েছিল সীতারামকেই। তখন না হয় বামেদের ৬৪ জন সাংসদ ছিলেন। বামেদের কথার গুরুত্ব থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই কঠিন সময়ে, যখন বাংলায় বামেরা শূন্য, যখন লোকসভায় কেরল থেকে কোনওরকমে চারজনকে জিতিয়ে আনা গেছে, সেই সময়েও ইন্ডিয়া জোটের বড় এক স্তম্ভ ছিলেন সীতারাম। মাস খানেক আগে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বেজায় ক্ষেপে গেলেন। মূল অভিযোগ, রাহুল গান্ধী নাকি সীতারাম ইয়েচুরিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সীতারাম ইয়েচুরি নাকি ইন্ডিয়া জোটের সবাইকে চালনা করছেন। তৃণমূল নেত্রীর রাগ হওয়ার সঙ্গত কারণ আছে। লোকসভা–রাজ্যসভা মিলিয়ে তাঁর হাতে বিয়াল্লিশখানা সাংসদ। তিনি গুরুত্ব পাচ্ছেন না। অথচ, বাংলায় শূন্য হয়ে যাওয়া সিপিএমের কথা কিনা রাহুল গান্ধী শুনছেন! সত্যিই তো, কে এই সীতারাম। আসলে, সীতারাম ইয়েচুরি এমন একজন, যাঁকে গুরুত্ব না দিয়ে পারা যায় না। তাতে এমপির সংখ্যা যতই চার হোক। এই সহজ সত্যিটা রাহুল গান্ধীও বোঝেন, ইন্ডিয়া জোটের বাকিরাও বোঝেন।
খুব ভারী ভারী কথা হচ্ছে। একটু ছাত্রাবস্থায় ফিরে যাওয়া যাক। দশম শ্রেণির পর চলে আসেন দিল্লিতে। দ্বাদশ শ্রেণিতে সর্বভারতীয় স্তরে প্রথম। সেন্ট স্টিফেন্স থেকে অর্থনীতির স্নাতক। জেএনইউতে স্নাতকোত্তর। দুটি ক্ষেত্রেই প্রথম শ্রেণি। এসব নয়। দুটি অন্য ঘটনার উল্লেখ খুব জরুরি। জেএনইউ–কে যে বাম ঘাঁটি বলা হয়, সেই বাম ঘাঁটি নির্মাণের কাজটা করেছিলেন এই সীতারাম ইয়েচুরি–প্রকাশ কারাতরা। তিনি তখন ছাত্র সংসদের সভাপতি। জেএনইউ–র অধ্যক্ষ তখন ইন্দিরা গান্ধী। দেশজুড়ে চলছে জরুরি অবস্থা। বাংলাদেশ যুদ্ধের পরের ইন্দিরা। জরুরি অবস্থার ইন্দিরা। গোটা দেশ যেন তাঁর নামে থরহরি কম্পমান। এমন সময় জেএনইউতে প্রবল ছাত্রবিক্ষোভ। প্রধানমন্ত্রী এলেন জেএনইউ ক্যাম্পাসে। তাঁর সামনে দাবি সনদ পেশ করলেন ছাত্ররা। ছাত্র সংসদের সভাপতি হিসেবে সেই সনদ পাঠ করলেন সীতারাম ইয়েচুরি। একগুচ্ছ অনিয়মের অভিযোগ এনে ইন্দিরার সামনেই তাঁর পদত্যাগ চেয়ে বসলেন সীতারাম। ইন্দিরা ভাবতেই পারেননি, ছাত্ররা তাঁর সামনেই এভাবে তাঁর পদত্যাগ চেয়ে বসবেন। ইন্দিরা কী করেছিলেন? হ্যাঁ, ফিরে গিয়েই নিজের পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
সেই জরুরি অবস্থার পঞ্চাশ বছর। বড় অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল আমাদের কলকাতায়। আরজি কর কাণ্ডের পর আন্দোলনরত পড়ুয়ারা গেলেন লালবাজার। পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে উপহার দিলেন প্রতীকী শিরদাঁড়া। সেইসঙ্গে তাঁদের দাবিসনদে ছিল, পুলিশ কমিশনারকে পদত্যাগ করতে হবে। দিল্লির হাসপাতালে তখন অচৈতন্য অবস্থায় সীতারাম ইয়েচুরি। কোথায় যেন মিলে গেল জেএনইউ ও আরজি কর। কোথায় যেন মিলে গেলেন সেদিনের তরুণ সীতারাম আর আজকের প্রতিবাদী ছাত্ররা। ইতিহাস এভাবেই ফিরে ফিরে আসে। লড়াইয়ের ব্যাটন এভাবেই এক হাত থেকে অন্য হাতে পৌঁছে যায়।