ভাগ্যিস ছন্দা সেনকে এমন চিৎকার করতে হয়নি

দিব্যেন্দু দে

আমাদের বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় কোনও স্মার্ট ফোন ছিল না। কোনও ল্যাপটপ বা ইন্টারনেট ছিল না। সত্যি কথা বলতে কী, এসব শব্দগুলোই হয়তো ডিকশেনারিতে ছিল না। আমাদের বিনোদন বলতে ছিল একটা বোকা বাক্স। যার নাম টেলিভিশন। তখনও কালার টিভি সেভাবে ঢুকে পড়েনি। দুদিকে সাটার টানা সাদা কালো ওয়েস্টার্ন বা ওয়েবেল। ছাদের ওপর টাঙানো থাকত অ্যান্টেনা। মাঝে মাঝেই হাওয়ায় নড়ে যেত। ছবি ঝিলমিল করত। আবার কেউ একটা ছাদে গিয়ে এদিক–‌ওদিক ঘুরিয়ে ঠিক করত।

আমাদের বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় ঘনঘন চ্যানেল বদলানো ছিল না। সেই টিভিতে যেটা হত, সেটাই দেখতে হল। সে চিচিং ফাঁক হোক বা চিত্রমালা। সে সকালের রামায়ন হোক বা রাতের মালগুডি ডেজ। শুরুর দিকে নিজেদের বাড়িতে টিভিও ছিল না। বন্ধুদের বাড়িতে বা পাড়ায় অন্য কোনও কাকু–‌জেঠুর বাড়িতে সবাই ভিড় করতাম। মূলত সকালের রামায়ন, আর শনি ও রবিবারের সিনেমা। হিন্দি সিনেমা দেখার ছাড়পত্র তখনও সেভাবে আসেনি। মূলত বাংলা ছবিই দেখতে হত।

আর বিকেল পাঁচটার বাংলা ছবি মানে, মাঝখানে থাকবে বাংলা সংবাদ। কবে কে খবর পড়বেন, আগে থেকে বাজি ধরাও চলত। আজ কে আসবেন?‌ তরুণ চক্রবতী নাকি কমলিকা ভট্টাচার্য?‌ দেবরাজ রায় নাকি ছন্দা সেন?‌ দেবাশিস বসু নাকি ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য?‌

‌এঁদের মধ্যে সবথেকে আটপৌরে ছিলেন ছন্দা সেন। খুবই সাধারণ পোশাক। মুখে কোনও মেক আপ নেই। কোনও উত্তেজনা নেই। কোনও অতিনাটকীয়তা নেই। একেবারে ধীর, স্থির, শান্ত। অন্যদের প্রেমে পড়া যায়। কিন্তু ছন্দা সেনের মধ্যে যেন অদ্ভুত এক মাতৃস্নেহ। তিনি যেন স্কুলের সেই স্নেহপরায়ণ দিদিমণি।

আমার এক মেসোমশাই ছিলেন। তিনি আবার কমলিকা ভট্টাচার্যের বিরাট ভক্ত। কমলিকার সেই ছোট করে কাটা চুল। তখন আমরা বলতাম, ববকাট। কমলিকা খবর পড়লে তিনি হাঁ করে তাকিয়ে থাকতেন। টিভির একেবারে সামনের চেয়ারটায় গিয়ে বসে পড়তেন। মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘‌আহা মেয়েটার কী সুন্দর গলা!‌ একে বিয়ে করলে জীবনটা ধন্য হয়ে যেত।’‌ ব্যস, মাসিকে আর পায় কে?‌ তিনি তো অগ্নিশর্মা। বলে উঠলেন, ‘‌তুমি থাকো তোমার কমলিকাকে নিয়ে। ওকে বিয়ে করলেই তো পারতে।’‌

তারও কিছুটা পরে, খবর পড়তেন আরও এক সুন্দরী ললনা। মধুমন্তী মৈত্র। তাঁকে ঘিরেও ছিল অনেকের তীব্র আকর্ষণ। আমার স্কুলের কয়েক বছর সিনিয়র দাদা লুকিয়ে লুকিয়ে মধুমন্তীকে চিঠি লিখত। তিনি কি সেই চিঠি পেতেন!‌ পড়তেন!‌ কী জানি। শুধু এটুকু জানি, মধুমন্তীর কাছ থেকে কোনও পাল্টা চিঠি কোনওদিন আসেনি। শোনা যায়, কমলিকা, ইন্দ্রাণীদের কাছেও প্রচুর ফ্যান মেল আসত। কেউ বিয়ে করতে চাইত। কেউ নিজের ছেলের বউ করতে চাইত। কেউ জানতে চাইত, কোন বিউটি পার্লারে চুল কাটেন। ছন্দা সেনের কাছে কি এই জাতীয় চিঠি আসত!‌ মনে হয় না। তবে বয়ষ্করা ছিলেন ছন্দা সেনের অনুরাগী। আমার এক মাস্টার মশাই। ছন্দা সেনের অনাড়ম্বর ভঙ্গির খুব তারিফ করতেন। বলতেন, ‘‌কোনও দেখনদারি নেই। কোনও অহঙ্কার নেই। একজন মানুষ কত সিম্পল থাকতে পারেন। এত এত মানুষ টিভির পর্দায় তাঁকে দেখছেন। তবু তিনি কী নির্লিপ্ত। এটা একটা কঠিন সাধনা। সবাই পারে না।’ একজন আবৃতির শিক্ষক ছিলেন। তিনি ছাত্র ছাত্রীদের বলতেন, ‘‌উচ্চারণ স্পষ্ট করো। বেশি অঙ্গভঙ্গি কোরো না। টিভিতে ছন্দা সেনকে দেখো। কী সহজভাবে তিনি খবর পড়েন। এটা শেখার চেষ্টা করো। সহজ থাকাটা কিন্তু খুব সহজ নয়।’‌ ‌

রেডিওতেও তাঁর খবর পড়া শুনেছি। টিভিতে দেখা মুখটা ভেসে উঠেছে। পরের দিকে এফএমেও তাঁর উপস্থাপনা শুনেছি। শ্রোতাদের সঙ্গে কী সাবলীল!‌ কী চমৎকার শব্দচয়ন। তার মাঝেও উঁকি দিত তাঁর সেন্স অফ হিউমার। আবার কোথায় মাত্রা টানতে হয়, সেটাও জানতেন। এই পরিমিতি বোধটাই তাঁকে বাকিদের থেকে স্বতন্ত্র করেছিল।

এখন টিভিতে ঘনঘন ব্রেকিং নিউজের আবহ। কী তারস্বরে চিৎকার। অ্যাঙ্কররা যেন সাধারণ কথা সাধারণভাবে বলতেই ভুলে গেছেন। সবেতেই উত্তেজনা। এতে নাকি টিআরপি বাড়ে। সত্যিই কি তাই!‌ এমন অকারণ চিৎকার দর্শকরা পছন্দ করেন!‌ মনে তো হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই অ্যাঙ্কররা সত্যিই দুর্ভাগা। তারা কখনও ছন্দা সেনকে দেখেনি। আবার উল্টোটাও মনে হয়। ছন্দা সেনটা সত্যিই লাকি। খবর পড়তে গিয়ে তাঁদের কখনও এমন চিৎকার করতে হয়নি।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.