ধীমান সাহা
কোনও সন্দেহ নেই, বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন দুর্বৃত্ত এর আগে আসেনি। এবং এঁকে রাজনীতিক না বলে মাফিয়া, ক্রিমিনাল বলাই যুক্তিসঙ্গত। তৃণমূলের সবার মিলিত দুর্নীতি আর এই কীর্তিমানের একক দুর্নীতি। দাঁড়িপাল্লায় মাপলে এই কীর্তিমানের পাল্লাই হয়তো ভারী হবে। কার সম্পর্কে এত কথা? বলার জন্য কোনও পুরস্কার নেই।
কিন্তু তারপরেও কী অবলীলায় তিনি হুঙ্কার দিয়ে যান। তারপরও কী অবলীলায় বলে যান, আমার বিরুদ্ধে একটা দুর্নীতি প্রমাণ করুক।....।।
সিবিআই, ইডি যে তাঁর বিরুদ্ধে কার্যত কিছুই করবে না, এটা মোটামুটি পরিষ্কার। তিনি যখন ইডি–র জেরা থেকে বেরিয়ে দেড় ঘণ্টা প্রেস কনফারেন্স করেন আর পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন, তখন কেন জানি না, তাঁর ওপর আর রাগ হয় না। রাগ হয় ভেতরে বসে থাকা ইডি–র ওই আধিকারিকদের ওপর। রাগ হয় দিল্লিতে বসে থাকা ওই মাতব্বরদের ওপর। ইডির জেরা থেকে বেরিয়ে এসে এই হুঙ্কার ঝাড়ার সাহস তিনি পাচ্ছেন কোত্থেকে? মাথায় কার হাত রয়েছে? শুধু পিসির হাত থাকলে এত হুঙ্কার ঝাড়া যায় না। নিশ্চিতভাবে আরও কোনও প্রভাবশালী মামা আছেন।
যাই হোক। এবার বামেদের প্রসঙ্গে আসি। দিল্লি তাঁকে বাঁচাতে চাইছে, এটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, বামেরাও বোধ তাঁকে বাঁচানোর, তাঁকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন। বামেদের হাতে ইডি নেই, সিবিআই নেই, পুলিশ নেই, মিডিয়া নেই। সামর্থ্য সত্যিই সীমিত। কিন্তু তারপরেও যদি বামেরা কিছুটা হলেও দায়িত্ব পালন করতেন, তাহলে বোধ হয় তিনি এতখানি বেপরোয়া হয়ে ওঠার সাহস পেতেন না।
কয়েকটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ১) নিজের নির্বাচনী হলফনামায় এবারও তিনি নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা লিখেছেন এমবিএ। অথচ, কার্যত তিনি উচ্চ মাধ্যমিক। কারণ, যে প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি বিবিএ ও এমবিএ করেছেন, সেই প্রতিষ্ঠান অবৈধ। তাদের কোনও ডিগ্রি দেওয়ার এক্তিয়ার নেই। খোদ দেশের সুপ্রিম কোর্ট এমন রায় দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও ২০১৯ এর নির্বাচনে তিনি এমবিএ লিখেছিলেন। এবারও তেমনই লিখলেন। তিনি যে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে মিথ্যে তথ্য দিয়েছেন, এই মর্মে নির্বাচন কমিশনে কি কোনও অভিযোগ জমা পড়েছে? পার্লামেন্টেও অভিযোগ জানানো যায়। হয়েছে? আদালতেও নিশ্চয় জনস্বার্থ মামলা করার সুযোগ আছে। কোনটা কীভাবে করা যায়, সেটার ব্যাপারে উপযুক্ত আইনি পরামর্শ দেওয়ার মতো লোকের অভাব নেই। তাতেও ফল না হলে নিরন্তর প্রচারে আনা যেত।
নির্বাচন কমিশন কড়া পদক্ষেপ নিতে চাইলে হয়তো সাংসদ পদ খারিজ হতে পারে। নিদেনপক্ষে, ওই ডিগ্রি মুছে হায়ার সেকেন্ডারি লেখার নির্দেশ দিতে পারত। সেটাই তাঁর বড় একটা পরাজয় হত। এবং এটা করতে কোনও জনবল লাগে না, অর্থবল লাগে না, বাহুবল লাগে না, মিডিয়ার আনুকূল্য লাগে না। দরকার শুধু একটু আইনি জ্ঞান। যেখানে অন্যদের থেকে বামেরা অনেক এগিয়ে। তারপরেও তাঁরা কার্যত নীরব।
২) ডায়মন্ড হারবারে প্রার্থী নিয়ে যে ধরনের জট তৈরি হল, তা কাম্য ছিল না। অনেক আগে থেকে বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করা যেত। দরকার হলে আইএসএফ–কে আরও একটা, দুটো আসন ছাড়া যেত। যদি মনে হত নিজেরা লড়ব, তাহলে তার প্রস্তুতিও আগে থেকে হওয়া দরকার ছিল। বিজেপি যেমন সবার শেষে ডায়মন্ড হারবারে প্রার্থীঘোষণা করল, বামেরাও তাই। অর্থাৎ, শুরুতেই বুঝিয়ে দেওয়া হল যে, আমরা ছত্রভঙ্গ, আমাদের কোনও প্রস্তুতি ছিল না, আমরা আগেই হার মেনে নিয়েছি।
৩) এই কেন্দ্রে বামেরা জিতত, এখনই এতখানি আশাবাদী না হওয়াই ভাল। তারা যে ভোট করতে দেবে না, জানা কথা। প্রশাসনকে নগ্নভাবে কাজে লাগাবে, জানা কথা। কেন্দ্রীয় বাহিনি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে, এটাও জানা কথা। মিডিয়াকে ঢুকতে দেবে না, এটাও অজানা ছিল না। অর্থাৎ, লড়াইটা সবদিক থেকেই অসম। এটা প্রতিরোধ করা হয়তো সম্ভবও ছিল না। এই বাস্তবতা না মেনে উপায় নেই।
তাই বলে গণনার দিনও সবাইকে মেরে বের করে দিল? প্রত্যন্ত এলাকার বুথে সন্ত্রাস হলেও আটকানো মুশকিল। তার প্রমাণও থাকে না। কিন্তু গণনাকেন্দ্র তো হেস্টিংস। সেখানেও সন্ত্রাস ঠেকানো গেল না! এমনকী কারও নজরে আনাও গেল না! কেন্দ্রীয় বাহিনির সামনেই প্রথমে বিজেপির সবাইকে বের করে দেওয়া হল। সকাল নটার মধ্যে বামেদেরও বের করে দেওয়া হল। তারপরেও আমরা পুনর্গণনার আবেদন জমা পড়ল না! গণনাকেন্দ্রে তো সিসিটিভির সামনেই যা হওয়ার হয়েছে। চাইলেও সব প্রমাণ লোপাট করতে পারত না।
স্বাভাবিক ভোট হলেও হয়ত তিন লাখে জিততেন। ভোটের সন্ত্রাসে বেড়েছে আরও দু লাখ। আর গণনাকেন্দ্রের সন্ত্রাস ও কারচুপিতে হয়তো আরও দু’লাখ।
পুনর্গণনার আবেদন করতে গেলে যেটুকু ন্যূনতম প্রমাণ দরকার, সেটুকু জোগাড় করা খুব একটা কঠিন কাজ ছিল বলে মনে হয় না। অন্তত সেদিন গণনার ফুটেজ আদালতকে দেখার আর্জি জানানো যেত। তাতে এটুকু পরিষ্কার হত যে, অন্য দলের এজেন্ট নেই। পুনর্গণনা হলে অন্তত দু’লাখের কারচুপি ধরা পড়বে। তখন এটুকু জোর দিয়ে বলা যেত, যারা গণনায় দু লাখ কারচুপি করতে পারে, তারা ভোটের দিন কতটা করতে পারে! কিন্তু তারপরেও পুনর্গণনা চেয়ে কোর্টে যাওয়া হল না। কদিন পর আর সেই সুযোগও থাকবে না।
এরপরে আমরা কোন মুখে সিবিআই, ইডি বা কেন্দ্রকে দায়ী করি! আমাদের যেটুকু করণীয়, আমরা তার কতটুকু করতে পেরেছি? এই আত্মসমালোচনাটাও জরুরি।
বামেদের এত শক্তিশালী সোশ্যাল মিডিয়া। কিন্তু তারপরেও কজন জানেন যে, ওইদিন গণনাকেন্দ্রে বামেদের এজেন্টদের থাকতেও দেওয়া হয়নি! একেক বুথে কী অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে, সেই পরিসংখ্যান কতটুকুই বা তুলে ধরা গেছে!
এই রাজ্যের আসল শত্রু কে, আমরা এখনও হয়তো চিনতে পারিনি। সব দুর্নীতির আসল মাথা কে, আমরা এখনও চিনতে পারিনি, চেনাতেও পারিনি।
মমতা মুখ্যমন্ত্রী। অনেক দুর্নীতিতে তাঁর নৈতিক দায় নিশ্চয় আছে। অনেক ক্ষেত্রে জেনেশুনে প্রশ্রয়ও আছে। প্রশাসনিক ব্যর্থতাও আছে। কিন্তু আসল মাথা কখনই তিনি নন। কিন্তু আমরা অনেকসময় মমতাকে নোঙরাভাবে আক্রমণ করি। তাঁকে কোমরে দড়ি দিয়ে জেলে ভরব বলে হুঙ্কার ঝাড়ি। নিজের অজান্তেই আমরা আসল অপরাধীকে আড়াল করি। আবার বলছি, এই ভুঁইফোড় ভাইপোর অপরাধের ধারেকাছেও মমতার অপরাধ আসে না। মমতার সমস্ত ত্রুটি ও অপরাধকে অন্তত এক হাজার দিয়ে গুন করলে তবে একটি অভিষেক হয়। তারপরেও আমরা আসল অপরাধী কে, এখনও চিনি না।
তাই তিনিও পরম নিশ্চিন্তে থাকেন। তিনি জানেন, তিনি ভুয়ো এমবিএ হলেও কোনও অভিযোগ জমা পড়বে না। কোনও মামলা হবে না। তিনি গণনাকেন্দ্র থেকে বের করে দিলেও কোনও মামলা হবে না। কেন্দ্র কিছুই করবে না, সেই ব্যাপারে তিনি অনেকটাই নিশ্চিন্ত। এমনকী বামেরাও যেটুকু করণীয়, সেটুকুও করবে না, এই ব্যাপারেও তিনি বোধ হয় অনেকটাই নিশ্চিন্ত।