কোথায় বার্বাডোজ আর কোথায় বেহালা। প্রায় পনেরো হাজার কিমির দূরত্ব। কিন্তু কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার। ভারতের বিশ্বজয়ের পেছনে কোথাও না কোথাও যেন থেকে গেছেন এক বঙ্গসন্তান। নাম? বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু বলা, সৌরভ গাঙ্গুলি।
নিন্দুকেরা বলতেই পারেন, কোথায় বিরাট কোহলি–রোহিত শর্মারা বিশ্বকাপ জেতালেন, এর পেছনে সৌরভ গাঙ্গুলি উড়ে এসে জুড়ে বসলেন কীভাবে? বাঙালি, ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।
আচ্ছা, এই দলের অধিনায়কের নাম কী? রোহিত শর্মা। এই দলের কোচের নাম কী? রাহুল দ্রাবিড়। স্বাভাবিক নিয়মে কি এই দুজনের অধিনায়ক বা কোচ হওয়ার কথা ছিল? তিন বছর আগেও কি কেউ কখনো ভাবতে পেরেছিলেন, রোহিত অধিনায়ক হতে পারেন বা রাহুল কোচ হতে পারেন?
দু’জনই নিমরাজি। তাঁদের রাজি করানোর কাজটা খুব সহজ ছিল না। আর সেই কঠিন কাজটাই করেছিলেন একজন, সৌরভ গাঙ্গুলি। বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতীয় ক্রিকেটে ছিল রবি শাস্ত্রী–বিরাট কোহলি জুটি। একজন কোচ, অন্যজন অধিনায়ক। এই জুটিকে ব্যর্থ বলা যাবে না। আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে এই জুটির হাত ধরে ভারত টেস্টে এক নম্বরেও পৌঁছেছিল। কিন্তু তারপরেও কাপ আর ঠোঁটের মাঝে ফাঁক থেকে যাচ্ছিল। ট্রফি আর ধরা দিচ্ছিল না। সবকিছুরই একটা এক্সপায়ারি ডেট থাকে। এই জুটিরও ছিল।
আসলে, সব জুটি সবসময় ক্লিক করে না। ওয়েভ লেংথে ম্যাচ হল কিনা, সেটাও বড় একটা ব্যাপার। যেমন, অনিল কুম্বলের সঙ্গে বিরাট কোহলির জুটি বেশিদিন টেকেনি। হয়তো টেকার কথাও ছিল না। কারণ, দু’জনের দর্শনের মধ্যে মিল যতটা, অমিল তার থেকে ঢের বেশি।
রাহুল দ্রাবিড় ধীর, স্থির। শান্ত, ভদ্র। কখনই খুব একটা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তে দেখা যায় না। নিঃশব্দে নিজের কাজটা করে যান। প্রচারের সার্চলাইট টেনে নেওয়া নয়। বরং, একটু আড়াল খোঁজেন। তাঁর জন্য হয়তো বেঙ্গালুরুর জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিই সেরা জায়গা। নতুন প্রতিভাদের ঘসেমেজে তৈরি করবেন। ভবিষ্যতের সাপ্লাই লাইন তৈরি করবেন। এতে তিনি নিজেও বোধ হয় স্বচ্ছন্দই ছিলেন। তাই সিনিয়র দলের কোচ হওয়ার ব্যাপারে কোনও আগ্রহ দেখাননি। বরং, বেশ অনিচ্ছাই ছিল। তাছাড়া, কুম্বলের সঙ্গে বিরাটের যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল, রাহুলের সঙ্গেও তা হতেই পারত। দুজনের পক্ষেই দুজনকে হজম করা হয়তো মুশকিল হত।
কিন্তু তখন বোর্ডের মসনদে সৌরভ গাঙ্গুলি। তিনি চাইছিলেন রাহুল দ্রাবিড় এই দলের রাশ হাতে নিন। বহু বছরের সতীর্থ রাহুলকে তিনি বেশ ভালমতোই চেনেন। কোথায় তাঁর ‘কমফোর্ট জোন’ কোথায় তাঁর অনীহা, এটাও বেশ বোঝেন। তাই রাহুলকে বোঝানোর দায়িত্বটা তিনিই নিলেন। একটা সময় ছিল, যখন একদিনের দলে রাহুলের জায়গা হচ্ছিল না। উপায় বাতলে দিয়েছিলেন অধিনায়ক সৌরভই। উইকেট কিপিং করিয়ে ঠিক জায়গা করে দিলেন মিস্টার ডিপেডেবলকে। এবারও ঠিক রাজি করিয়েই ফেললেন।
এমন সময় বোর্ডের সঙ্গে কিছুটা ঠান্ডা লড়াই চলছিল বিরাট কোহলির। ব্যাটে রানও ছিল না। তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্নও উঠছিল। কোহলির যা দাপট, কোথাও একটা রাশ টানার দরকারও ছিল। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? সৌরভের নেতৃত্বে বোর্ড বুঝিয়ে দিল, বিরাট দলের মধ্যে যে সংস্কৃতি আমদানি করতে চাইছেন, তাতে বোর্ডের সায় নেই। আর এই অপ্রিয় কাজটা করতে হল সৌরভকেই। যে কোনও কারণেই হোক, বিরাট একসময় নেতৃত্ব ছেড়েও দিলেন। সেই সময় বিকল্প কে? রোহিতও কিছুটা নিমরাজিই ছিলেন। আইপিএলে তাঁর নেতৃত্বে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দেশের নেতৃত্বে তখনও সেভাবে পরীক্ষিত নন। বাকি কটা দিন একটু খোলা মনেই খেলতে চাইছিলেন। তিনি ব্যাট হাতে ঝড় তুললেও স্বভাবগতভাবে অনেকটাই ধীর, স্থির, শান্ত। অতিরিক্ত আগ্রাসন বা দেখনদারি— কোনওটাই তেমন নেই। রাহুলের সঙ্গে বেশ মিল। অন্তত রাহুল–বিরাট রসায়নের থেকে রাহুল–রোহিত রসায়ন অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। দূরদর্শী সৌরভের এই সহজ সমীকরণটা বুঝতে ভুল হয়নি। তাই অনিচ্ছুক রোহিতকেও শেষমেশ ইচ্ছুক করলেন। ভরসা দিলেন। এই জুটি একদিনের বিশ্বকাপেও টানা দশ ম্যাচ জিতে দেশকে ফাইনালে তুলেছিল। ততদিনে বোর্ডের মূলস্রোত থেকে সৌরভ অনেকটাই দূরে। কিন্তু বোর্ডকর্তারাও বুঝলেন, টি২০ বিশ্বকাপে জিততে হলে এই জুটির ওপরই ভরসা রাখতে হবে।
দেশের মাটিতে যে স্বপ্নপূরণ হয়নি, তা দল সুদূর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে। ১৭ বছর পর এল টি২০ বিশ্বকাপ। রোহিত কাপ তুলে দিলের রাহুলের হাতে। একটা বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ। বোর্ড কর্তারা উড়ে গিয়েছিলেন সুদূর বার্বাডোজে। সৌরভ যথারীতি অনেক দূরে। কিন্তু বছর দুই আগে যে জুটিটা তৈরি করেছিলেন, সেই জুটির হাতে কাপ দেখে তৃপ্তির হাসি কি তাঁর ঠোঁটেও ছিল না!