স্বরূপ গোস্বামী
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বাড়িতে নিয়ম করে রোগী দেখতেন বিধানচন্দ্র রায়। কারও কাছেই কোনও ভিজিট নিতেন না। একেবারেই নিখরচায়। সেই বিধানচন্দ্রই ভিজিট চেয়ে নিয়েছিলেন বিশেষ একজনের কাছে। তিনিও আবার যেমন তেমন রোগী নন। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ড জন কেনেডি।
এই ভিজিট চাওয়ার পেছনে রয়ে গেছে মজার এক কাহিনী। যা পরবর্তীকালে অনেকেই লিখে গেছেন। মুখ্যমন্ত্রীদের বিদেশ সফর নতুন কিছু নয়। ঘটা করে অফিসার, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীদের বগলদাবা করে বিদেশ সফর অনেক মুখ্যমন্ত্রীই করে থাকেন। কিন্তু বিদেশ সফরে গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতির চিকিৎসা! এমনটা আর কারও ক্ষেত্রেই ঘটেনি। চিকিৎসা তো দূরের কথা। মার্কিন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আর কোনও মুখ্যমন্ত্রী সাক্ষাৎ করতে পেরেছেন বলেও জানা নেই। এটা সম্ভব হয়েছিল তিনি বিধান রায় বলেই।
ব্যান্ডেল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে একটি মার্কিন সংস্থার মউ চুক্তি হওয়ার কথা। অর্থাৎ, সেই সংস্থা প্রযুক্তিগত সহায়তা করবে। সেই কারণেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর আমেরিকা যাত্রা। হাতে কয়েকদিন বাড়তি সময় নিয়েই গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। চুক্তি স্বাক্ষর হয়ে গেল। এবার তিনি ঠিক করলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করবেন। আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূতকে বললেন, যেভাবে হোক, আমার জন্য একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করো। কিন্তু রাষ্ট্রদূত সাফ জানিয়ে দিলেন, এভাবে মার্কিন রাষ্ট্রপতির অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাওয়া যায় না। এভাবে হুট করে তাঁর সঙ্গে দেখা করা যায় না। তাছাড়া, তিনি দেখা করলে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে দেখা করবেন। এভাবে একজন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন কেন? এটা প্রোটোকলে আটকে যাবে।
কিন্তু বিধান রায়ও নাছোড়। তিনি এসেছেন যখন, দেখা করেই যাবেন। বুঝলেন, রাষ্ট্রদূতকে দিয়ে হবে না। সেখান থেকে ফোন করে বসলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে। বললেন, জওহর, আমি এখানে এসেছি যখন, তখন কেনেডির সঙ্গে দেখা করেই যাব। কিন্তু তোমার রাষ্ট্রদূত আমাকে প্রোটোকল বোঝাতে শুরু করেছে। এই বয়সে ওসব বুঝে আমার কাজ নেই। তুমি ওকে বলো, ও যেন প্রেডিডেন্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে।
নেহরু জানতেন, বিধান রায় যখন জেদ ধরেছেন, তখন দেখা করেই ফিরবেন। তাঁকে প্রোটোকল বুঝিয়ে লাভ হবে না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে রাষ্ট্রদূত চেষ্টা করলেন কেনেডির অ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করার। তিন দিন পর সেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেল। কেনেডির সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হল। দুই দেশের ঐতিহ্য, পারস্পরিক সম্পর্ক, উন্নয়ন–এসব নিয়েই মূলত আলোচনা। বিধান রায়ের সঙ্গে কথা বলে তখন অনেকটাই মুগ্ধ কেনেডি। ঠিক এমন সময়েই মোক্ষম কথাটি বলে ফেললেন বিধান রায়। তিনি বললেন, আমি শুনেছি, আপনি পিঠের ব্যথা নিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছেন। আমি কি আপনার চিকিৎসা করতে পারি? কেনেডি সাগ্রহে রাজি হয়ে গেলেন। বিধান রায় খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন। পুরনো কী কী ওষুধ ব্যবহার করতেন, সেগুলো দেখতে চাইলেন। সেগুলো দেখার পর বললেন, এতদিন আপনার ভুল চিকিৎসা হয়েছে। কয়েকদিন আপনি আমার কথা শুনে চলুন। আমি নিশ্চিত, আপনি ফল পাবেন। প্রয়োজনে আমি আবার এসে আপনার চিকিৎসা করে যাব।
তারপরই বিধান রায় বলে বসলেন, দেখা হল। চিকিৎসাও হল। কিন্তু আপনি ডাক্তারির ভিজিটটা দেবেন না?
মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিকিৎসা করাই যে কোনও ডাক্তারের চরম সৌভাগ্য। সারা জীবন এটাকে ভাঙিয়েই নিজেকে যে কেউ জাহির করবেন। সেখানে এই ডাক্তার কিনা ভিজিট চেয়ে বসলেন! তাঁর কাছে যে এভাবে কোনও ডাক্তার ভিজিট চাইতে পারেন, কেনেডি ভাবতেও পারেননি। মনে মনে হয়ত এই সাহসকে তারিফই করলেন। হতচকিত কেনেডি বললেন, বলুন, কত ভিজিট চান!
বিধান রায় বললেন, আমার জন্য কিছুই চাই না। কিন্তু আমার রাজ্যের জন্য আপনার সাহায্য চাই। আপনি যদি তিনশো কোটি টাকা সাহায্য করেন, তাহলে আমার রাজ্যকে আরও ভালভাবে সাজাতে পারি। এভাবে কেউ কখনও তাঁর কাছে অনুদান চেয়েছেন কিনা জানা নেই। তবে বিধানবাবুর এই সৎ স্বীকারোক্তি কেনেডির মনকে ছুঁয়ে গেল। তিনি বলতেই পারতেন, ভেবে দেখছি। বলতেই পারতেন, পরে জানাব। কিন্তু সেসব রাস্তাতেই গেলেন না। সরাসরি বলে দিলেন, আমি রাজি। তবে আপনার দেশের অর্থমন্ত্রীকে বলবেন, আমাকে একটা চিঠি লিখতে। আমি অবশ্যই পাঠিয়ে দেব।
কিন্তু ফিরে এসেও নতুন জটিলতা। তখন অর্থমন্ত্রী মোরারজি দেশাই। বিধান রায় তাঁকে বললেন, কেনেডিকে চিঠি লিখতে। কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। তিনিও আইন আর প্রোটোকলের ফ্যাকড়া দেখাতে শুরু করলেন। তিনিও সেই রাষ্ট্রদূতের মতোই বলে বসলেন, একটা রাজ্যের জন্য এভাবে অন্য দেশের কাছে টাকা চাওয়া যায় না। কাল অন্য রাজ্যগুলোও এই দাবি করতে পারে। তাছাড়া, এই চিঠি লিখলে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। আমি এটা করতে পারব না।
বিধান রায় তাঁকে বোঝালেন, আমি সব ব্যবস্থা করে এসেছি। মার্কিন রাষ্ট্রপতি আমাকে কথা দিয়েছেন। তুমি চিঠি পাঠালেই হবে। এটা জাস্ট একটা ফর্মালিটি। এতে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কোনও ব্যাপার নেই। বুঝিয়ে দিলেন, তুমি চিঠি না দিলেও টাকা আসবে। শুধু এই বুড়ো বয়সে আমাকে আরেকবার যেতে হবে।
কিন্তু মোরারজি তাতেও রাজি নন। তিনি বিধান রায়ের এই ‘অদ্ভুত’ আবদারের কথা নেহরুকে শোনালেন। ভেবেছিলেন, নেহরু তাঁর কথায় সায় দেবেন। কিন্তু হল উল্টোটা। নেহরু মোরারজিকে বললেন, বিধান রায়কে ঘাঁটিও না। উনি যা বলছেন, তাই করো। উনি নিশ্চয় কিছু একটা ব্যবস্থা করেই এসেছেন।
অবশেষে অর্থমন্ত্রী চিঠি পাঠালেন। ততদিনে বিধান রায়ের ওষুধ কাজ করতে শুরু করেছে। ফলে, তাঁর প্রতি কেনেডির মুগ্ধতা আরও কিছুটা বেড়েছে। চিঠি পাওয়ার তিনদিনের মধ্যেই বাংলার জন্য তিনশো কোটির অনুমোদন চলে এল। সেই সময়ের তিনশো কোটি। এই সময় হলে সংখ্যাটা কত দাঁড়াত!
এমন অবিশ্বাস্য ব্যাপার সম্ভব হয়েছিল বিধান রায়ের জন্যই। কোনও প্রোটোকলের তোয়াক্কা না করেই তিনি মার্কিন রাষ্ট্রপতির কাছে ওই বিশাল অঙ্কের অনুমোদন আদায় করে এনেছিলেন। পৃথিবীর আর কোনও ডাক্তারের ভিজিট তিনশো কোটি হতে পারে!
এই একটা ব্যাপারে শুধু দেশের নয়, পৃথিবীর সব ডাক্তারকে এক লহমায় অনেকটা পেছনে ফেলে দিয়েছেন। তিনিই পৃথিবীর হায়েস্ট পেইড ডাক্তার।
****
বিধানচন্দ্রের স্মরণে বেঙ্গল টাইমসের বিশেষ ই ম্যাগাজিন। নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন। সেই ম্যাগাজিনটি খুলে যাবে।