প্রশান্ত বসু
উইশফুল থিঙ্কিং। অর্থাৎ, আমি কী চাই। আরও স্পষ্ট করে বললে, এবারের লোকসভায় এই বাংলায় আমি কোন প্রার্থীর জয় চাই। ভারী কঠিন বিষয়, আবার ভারী মজারও বিষয়। আমার কাছে তো ভূতের রাজার সেই বর নেই। আমার কাছে আলাদিনের সেই প্রদীপও নেই। আমি চাইলাম আর হয়ে গেল, এমনটা ভাবতে ভাল। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা হওয়ার নয়।
আমি এমন অনেকেরই জয় চাই, যাঁরা এবার জিতবেন না। এমনকী দ্বিতীয় স্থানটাও পাবেন না। অনেকটা পিছিয়ে থেকে হয়তো তৃতীয় হবেন। আবার আমি যাঁদের পরাজয় চাই, আমার চাওয়ার মুখে ঝাঁটা মেরে তাঁরা ড্যাং ড্যাং করে কয়েক লাখ ভোটে জিতে যাবেন। তবু যদি কারও জয় চাইতেই হয়, মানে কে জিতলে আমি মনে মনে খুশি হব, সেই তালিকায় অনেক নাম। অনেক ভেবে, অনেক কাটছাঁট করে একটা নামে এসে থামলাম। বহরমপুরে অধীর চৌধুরি।
আমি কোনওকালেই কংগ্রেসের ভোটার নই। সারা জীবনে অধীর চৌধুরিকে কখনও চোখে দেখিনি। এমনকী এই নামটা সম্পর্কে দীর্ঘদিন কেমন একটা অ্যালার্জিই ছিল। মনে হত, রাজনীতির আঙিনায় এইসব লোক কেন? কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ছে। মনে হচ্ছে, এই লোকটার হয়তো অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু এই লোকটা আর যাই হোক, বিকিয়ে যাওয়ার মতো মানুষ নন। এত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেও মাথা উঁচু করে কীভাবে লড়াই করে চেলেছেন। এই মানুষটা হেরে গেলে কোথাও একটা সেই লড়াইটাও হেরে যাবে।
তিনি বাংলায় প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি। বলা হয়, তিনি বাংলার কতটুকু চেনেন? তিনি তো মুর্শিদাবাদ নিয়েই পড়ে থাকেন। একেবারেই ঠিক কথা। তিনি নিজেও অস্বীকার করেননি। তিনি সে অর্থে কখনই রাজ্য নেতা হতে চাননি। লোকসভার বিরোধী দলনেতা হওয়ার পরেও কখনও জাতীয় নেতা হওয়ার চেষ্টা করেননি। নিজের ভূখণ্ডেই খুশি থেকেছেন। জানেন, পায়ের তলায় মাটি না থাকলে এমন হাওয়ায় ভেসে রাজ্য নেতা হওয়ার কোনও মূল্যই নেই। গোটা দেশে, গোটা রাজ্যে যখন কংগ্রেস ক্ষয়িষ্ণু, তখন তিনি অন্তত তাঁর জেলায় এই পতাকা অনেকটাই প্রাণবন্ত রাখতে পেরেছেন। সেই কারণেই সারাজীবন ভোটে না জেতা প্রণব মুখার্জিকে বলতে পারেন, আপনি জঙ্গিপুর থেকে দাঁড়ান। আপনাকে জেতানোর দায়িত্ব আমার। এই কঠিন সময়েও মহম্মদ সেলিম গিয়ে আশ্রয় খোঁজেন সেই মুর্শিদাবাদেই।
হ্যাঁ, আইএসএফের সঙ্গে জোটে তাঁর তেমন সায় ছিল না। এমনকী শরিকদের ব্যাপারেও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। যে আসন প্রাপ্য, তার থেকে অনেক বেশি আসন দাবি করেছেন। জোট রাজনীতিতে এই দর কষাকষি থাকবে। কিন্তু জোটের জন্য কীভাবে জানপ্রাণ লড়িয়ে দিতে হয়, এবার মুর্শিদাবাদে সেই পরীক্ষাও দিয়েছেন। একটি আসনেই বামেদের জেতার সম্ভাবনা উঁকি মারছে, সেটা অধীরের সৌজন্যেই।
আর কজন নেতা এভাবে বুক চিতিয়ে লড়তে পারেন? এখনও বিশ্বাস করি, ২০১৬–র পর বাম–কং জোট ভেঙে না গেলে বিজেপি এভাবে দ্বিতীয় হয়ে উঠে আসতে পারত না। জোট করার ব্যাপারে, জোট রাখার ব্যাপারে অধীরবাবু বরাবরই আন্তরিক ভূমিকাই পালন করেছেন। দিল্লি যখন তৃণমূলের সঙ্গে আঁতাত করে এই বাংলায় কয়েকটা আসনের স্বপ্ন দেখছে, তখন হাইকান্ডের সঙ্গে পাল্টা লড়াই চালিয়ে গেছেন। ক্ষীণ শক্তি নিয়েও বারবার বুঝিয়েছেন, জোট যদি করতেই হয়, বামেদের সঙ্গে হোক, তৃণমূলের সঙ্গে কোনওভাবেই নয়। এই চরম প্রতিকূল অবস্থাতেও বলতে পারেন, ‘তৃণমূলের দয়ায় জিততে চাই না।’ বুকের পাটা লাগে বইকি!
তাই অধীর শুধু কংগ্রেসের প্রতীক নন। তিনি আসলে লড়াইয়ের প্রতীক। লড়াই কঠিন জেনেও হাল না ছাড়ার প্রতীক। যে বামেরা একসময় অধীরকে চরম অপছন্দ করতেন, অধীরের জয়ে তাঁরাও কি খুশি হবেন না? বিজেপি–র নিচুতলার কর্মীরাও নিশ্চয় অখুশি হবেন না। এমনকী তৃণমূলের ভেতরের বিরাট একটা অংশও মুখে যাই বলুন, মনে মনে খুশিই হবেন। হ্যাঁ, এটাই অধীরের ক্যারিশ্মা।