তোর্সা চ্যাটার্জি
এখানে একসময় বাংলো কিনেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। বাংলোর হাতবদল হল। তাঁর কাছ থেকে কিনে নিলেন বুদ্ধদেব গুহ। সেই মালিকানাও বদলে গেল। তাঁর বাংলো চলে গেল অপর্ণা সেনের হাতে।
বলুন তো কোন জায়গা ?
মহাশ্বেতা দেবী বা বুদ্ধদেব গুহর লেখায় ঘুরেফিরে বারবার এসেছে এই ম্যাকলাস্কিগঞ্জের কথা। এখানে কতবার এসেছেন। কত লেখা লিখেছেন। ছত্রে ছত্রে রয়ে গেছে ইংরেজদের তৈরি এই শহরের কথা।
শহর না বলে গঞ্জ বলাই ভাল। সেদিনও গঞ্জ ছিল। আজও সেইরকমই আছে। স্টেশনের আশেপাশে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো কয়েকটি দোকান। এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা সাহেবদের বাংলো বাড়ি। আর শুধুই জঙ্গল। জঙ্গলের বুক চিরে চলে গেছে রাস্তা। কোথাও সমতল, কোথাও একটু চড়াই-উতরাই। চাইলে, সেই রাস্তা দিয়েই মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে পারেন।
কয়েক বছর আগে হলে হেঁটে যাওয়াটাও মুশকিল ছিল। মাওবাদিদের মুক্তাঞ্চল ছিল এইসব এলাকা। গেলেও পুলিশ আটকে দিত। রাস্তার পথচারীরা অচেনা লোক দেখলেই বলত, ‘উধার মত যাইয়ে। কুছ ভি হো সাকতা হ্যায়।’ তার মানে কি বাঘ সিংহ থাকতে পারে ? অন্য কোনও বন্য জন্তু ? না, আসলে কে কাকে কখন কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়, কী মুক্তিপন দাবি করে বসে, কে জানে!
এখন সেই আতঙ্ক অনেকটাই কেটে গেছে। যে কোনও কারণেই হোক, মাওবাদিরা অনেক ছত্রভঙ্গ। তাই এখন পর্যটকরা নিশ্চিন্তেই যেতে পারেন।
কিন্তু কীভাবে যাবেন ? যাওয়ার রুটটা খুব সহজ হবে না। কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেন বলতে শক্তিপুঞ্জ। কিন্তু সে ম্যাকলাস্কিগঞ্জে নামায় প্রায় রাত একটা নাগাদ। আরও দেরিও হতে পারে। এত রাতে কোথায় হোটেল খুঁজবেন ? আর শীতের রাত হলে তো কথাই নেই। ওই ঠাণ্ডায় হয়ত স্টেশনেই কাটাতে হবে। তার থেকে অন্য ট্রেনই ভাল। কোনও ট্রেন ধরে রাঁচিতে চলে আসুন। সেখান থেকে দেড় ঘণ্টার মতো।
এই গঞ্জ গড়ে ওঠার পেছনে বাঙালিদের কৃতিত্ব নেই বললেই চলে। পুরোটাই সাহেবদের হাতের তৈরি। প্রায় দশ হাজার একর জমি কিনে নিয়েছিলেন ম্যাকলাস্কি সাহেব। চেয়েছিলেন, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কলোনি তৈরি করবেন। বড় শহর থেকে অনেক দূরে, একটা অন্যরকমের কলোনি তৈরিও হয়েছিল। ম্যাকলাস্কি সাহেব অবশ্য বেশিদিন বাঁচেননি। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর নামেই এলাকার নাম হয় ম্যাকলাস্কিগঞ্জ।
আশেপাশের পুরো এলাকাই পাহাড় আর জঙ্গল ঘেরা। কিন্তু ম্যাকলাস্কিগঞ্জ যেন একেবারেই স্বতন্ত্র। এখানে পরতে পরতে ব্রিটিশ উপনিবেশের ছোঁয়া। সাহেবদের বড় বড় বাংলো বাড়ি। কিন্তু স্বাধীনতার পর ছবিটা অনেকটাই বদলে গেল। সাহেবরা জমি-বাংলো বিক্রি করে অনেকেই পালিয়ে গেলেন। সেই জমি আর বাংলাগুলি কিনে নিলেন সম্ভ্রান্ত বাঙালিরা। পরে সেইসব বাড়ি আর বাঙালিদেরও রইল না। অনেক বাংলোই এখন জরাজীর্ণ। কয়েকটা হোটেল, গেস্ট হাউস তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোও আস্তে আস্তে উঠে গেছে । তবে পর্যটকরা থাকতে চাইলে ছোটখাটো হোটেল বা গেস্টহাউস অবশ্যই আছে।
চাইলে নির্জন স্টেশনে বসে থাকতে পারেন। চাইলে জঙ্গলের বুক-চেরা রাস্তা দিযে হেঁটে আসতে পারেন। আর নইলে কয়েক ঘণ্টার জন্য একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে আশপাশের এলাকা ও প্রকৃতি ঘুরে দেখতে পারেন।
হয়ত গিয়ে দেখবেন অন্য কোনও পর্যটক নেই। হয়ত আপনারাই একমাত্র পর্যটক। দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। ভাল জায়গায় অল্প লোকেই যায়।