পঁচিশে বৈশাখ এলে বাঙালিকে আর পায় কে! সকাল থেকে কে কত বড় রবীন্দ্র অনুরাগী, তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ফেসবুকে রবীন্দ্রনাথের ছবির বন্যা। সঙ্গে দুটো বা চারটে লাইন। সেগুলো নির্ঘাত কপি পেস্ট করা। নইলে, নিজে টাইপ করতে গেলে ওই চার লাইনেই কী কী বানানের নমুনা যে হাজির হয়ে যেত, বলা মুশকিল।
রবীন্দ্রনাথ কিছুটা তৃপ্তি নিয়েই বলেছিলেন, আমার গান বাঙালিকে গাইতেই হবে। নিজের লেখা গান সম্পর্কে এমন একটা বিশ্বাস ছিল কবির। আসলে, মুদ্রার উল্টো পিঠের অন্ধকারটাও তখনই যেন দেখতে পেয়েছিলেন। বুঝেছিলেন, তাঁর কয়েকটা গানই শুধু বাঙালির কাছে টিকে থাকবে। তাঁর সাহিত্যের অন্য দিকগুলো বাঙালি বেমালুম ভুলে যাবে।
ঘুরেফিরে ওই কয়েকটা গান। ব্যস, আমাদের রবীন্দ্র চর্চার এখানেই ইতি। অনেকেই শান্তিনিকেতনে যান। এই ভবন, সেই ভবনের সামনে ছবি তুলে সেটা পোস্ট করেন। পাহাড়ে গেলে অনেকেই একবার মংপুটা ছুঁয়ে আসেন। রবি ঠাকুকের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন। পঁচিশে বৈশাখ বা বাইশে শ্রাবণ এলে রবীন্দ্র স্মরণের নাম করে সেইসব ছবি আরও একটা পোস্ট করেন। সঙ্গে দু’চার লাইন লিখে রবীন্দ্রনাথকে ধন্য করে দেন। যাঁরা কলকাতায় থাকেন, তাঁদের মধ্যে কজন জোড়াসাকোর ঠাকুরবাড়িতে গেছেন? যাঁরা দূরবর্তী জেলা থেকে কলকাতায় ঘুরতে আসেন, তাঁরা এই পার্ক, ওই মল–সব ঘুরে ফেলেন। কিন্তু জোড়াসাঁকোটা অধরাই থেকে যায়।
আমাদের বেড়ে ওঠার সময় প্রায় সব ক্লাসেই কোথাও না কোথাও রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি। কোনও ক্লাসে হয়তো তাঁর কবিতা, কোনও ক্লাসে তাঁর গল্প, কোথাও তাঁর নাটক। আর যাঁরা বাংলা নিয়ে অনার্স বা এমএ করেছেন, তাঁদের হয়তো পড়তে হয়েছে একটা বা দুটো উপন্যাস, নাটক। ব্যাস, গড়পড়তা বাঙালির সেখানেই রবীন্দ্র–চর্চার ইতি। একটা সমীক্ষা করুন তো, কজন বাঙালি রবীন্দ্রনাথের গোটা একটা উপন্যাস পড়েছেন। একটা নাটক পড়েছেন? নিদেনপক্ষে সিলেবাসের বাইরে গিয়ে একটা ছোট গল্প পড়েছেন! প্রবন্ধ, চিঠিপত্র— এগুলো তো বাদই দিলাম। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই বাস্তবচিত্র। হয়তো, সেই আক্ষেপ নিয়েই রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি।’ হ্যাঁ, আমরাও রবীন্দ্র পূজার ছলে তাঁকে ভুলেই থাকি।