স্বরূপ গোস্বামী
বিধানসভা নিয়ে কে আর মাথা ঘামায়? শাসকদল যেমন এর গুরুত্ব বোঝে না, বিরোধীরাও খুব একটা বোঝে না। মূলস্রোত মিডিয়ার তো বোঝার দায়ই নেই। প্যারালাল মিডিয়াও যে খুব বোঝে বা গুরুত্ব দেয়, এমন ভাবার কারণ নেই। সেই কারণেই স্পিকার একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে যান। কাগজে দু–তিন লাইনের বুড়ি ছোঁয়া খবর হয়।
আবার নিঃশব্দে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান ঠিক হয়ে গেল। এই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন কৃষ্ণ কল্যাণী। এতদিন তাঁকে বিজেপি বিধায়ক বলেই চালাচ্ছিলেন স্পিকার। কিন্তু এবার তিনি সরাসরি তৃণমূলের প্রার্থী। মনোনয়ন জমা দিতে গেলে পদত্যাগ করতেই হত। তাই পদত্যাগও করেছেন। অর্থাৎ, আর বিধানসভার সদস্যই নন। তাই অন্য একজনকে করতেই হত।
এবার কাকে বেছে নিলেন? আলিপুরদুয়ারের সুমন কাঞ্জিলালকে। এই কীর্তিমান ২০২১ এ বিজেপির হয়ে নির্বাচিত। কিন্তু গত বছর তৃণমূলের পতাকা হাতে নিয়ে ‘উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে’ সামিল হয়েছেন। তৃণমূলের হয়ে মিটিং করছেন, মিছিল করছেন, বিধানসভাতেও তৃণমূলের বেঞ্চেই গিয়ে বসছেন। এরপরেও স্পিকার সাহেব বলে যাবেন, তিনি তো বিজেপির বিধায়ক। আপাতভাবে মনে হতেই পারে, এটি মামুলি একটি খবর। আসলে, কোনটি খবর, কোনটি খবর নয়, এটা বোঝার মতো বোধটুকুও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তাই স্পিকারের চেয়ারে বসে একজন মানুষের সীমাহীন অপরাধকেও আমরা বড্ড লঘু করে দেখছি। তাঁর প্রতি কোনও রাগ তৈরি হয় না। কোনও ঘৃণা তৈরি হয় না। আমরা বোধ হয় একটু বেশিই সহনশীল হয়ে পড়েছি। কী জানি, আমরা হয়তো একটু বেশি ‘অজ্ঞ’ হয়ে পড়েছি।
২০১৬–র পর থেকে কারা কারা এই পদে এসেছেন, একবার চোখ বোলানো যাক। প্রথমে মানস ভুঁইয়া। যখন তিনি একটু বেসুরো, তৃণমূলে যাব যাব করছেন, সেই সময় তাঁকে পিএ কমিটির মাথায় বসানো হল। এবং বিরোধী দলের সুপারিশকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। তারপর সেই চেয়ারে আনা হল শঙ্কর সিংকে। যিনি কংগ্রেসের টিকিটে জিতলেও ততদিনে তৃণমূলে নাম লিখিয়ে ফেলেছিলেন। ২০২১ এর পর পিএসি চেয়ারম্যান করা হল মুকুল রায়কে। তিনিও ততদিনে তৃণমূলের পতাকা ধরে নিয়েছেন। তারপর আনা হল কৃষ্ণ কল্যাণীকে। এবার আরেক দলবদলু সুমন কাঞ্জিলালকে।
পিএসি চেয়ারম্যান বেছে নেওয়া নাকি স্পিকারের এক্তিয়ার। বেছে বেছে দলবদলুদের প্রতি স্পিকারের এত অনুরাগ কেন? তাঁদের প্রতি স্পিকারের এত স্নেহদৃষ্টি কেন? পিএসি চেয়ারম্যান করা হয় বিরোধী দল থেকে এবং বিরোধী দল যার নাম প্রস্তাব করে, সাধারণত তাঁকেই চেয়ারম্যান করা হয়। যেমন, লোকসভায় পিএসি চেয়ারম্যান অধীর চৌধুরি। এটা কিন্তু স্পিকার বেছে নেননি। এমনকী নরেন্দ্র মোদিও বেছে নেননি। কংগ্রেস সংসদীয় দল থেকে চাওয়া হয়েছিল, তাই অধীর চৌধুরি। হ্যাঁ, এটাই প্রথা। কিন্তু এই স্পিকার কবে আর প্রথা মেনেছেন?
অবশ্য অতীতের প্রথা বা পরম্পরা জানতে হলে একটু শিক্ষাদীক্ষা প্রয়োজন। তিনি যেসব কাণ্ডকারখানা করে চলেছেন, তাতে সেই শিক্ষার কোনও ছাপ নেই। এমন জোহুজুর মার্কা লোক কখনও স্পিকারের চেয়ারের সম্মান বাড়ায় না। এই সব লোকেরা এই পদের কলঙ্ক। হ্যাঁ, এমন স্পিকার থাকেন বলেই দলবদলুরা অনায়াসে দলবদল করতে পারেন। এমন স্পিকার থাকেন বলেই দলবদলুরা পিএসি চেয়ারম্যানও হয়ে যান। বলা হয়, স্পিকার পদের আলাদা একটা সম্মান আছে। তাই অনেকে এই পদের সমালোচনা থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু যিনি এই চেয়ারে বসছেন, তাঁকে এই সম্মানের যোগ্য হয়ে উঠতে হয়। তিনি নিজের চেয়ারকে কলঙ্কিত করে যাবেন, আর অন্যরা সম্মান দেখিয়ে যাবেন, এমনটা তো হতে পারে না। হ্যাঁ, চেয়ারের প্রতি সম্মান আছে। কিন্তু চেয়ারে বসা ওই অযোগ্য মানুষটির প্রতি একেবারেই নেই।
শাজাহানদের চেনা যায়। তাঁদের ধিক্কার দেওয়া যায়। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখতে গেলে, সাংবিধানিক চেয়ারে বসে এই ভদ্রলোক যা করে চলেছেন, সেটিও শাজাহানের অপরাধের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। বরং অনেক বেশি।