আলাপ হয়েছিল ঝগড়া দিয়ে। তারপর থেকে তাঁরা একে অপরের বন্ধু। সুচিত্রা সেনের বাড়িতে তাঁর জন্য অবারিত দ্বার। টুকরো টুকরো সেই মুহূর্তের ছবি উঠে এসেছিল বর্ষীয়াণ সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরির স্মৃতিচারণে।
বয়স বাড়লে স্মৃতিতে মরচে ধরে যায়। অনেককিছুই হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে। তবু কিছু কিছু কথা মনে দাগ কেটে যায়। সেগুলোর সাল–তারিখ হয়ত মনে থাকে না, তবে টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো নানা সময়ে মনে পড়ে যায়।
সাংবাদিকতার দীর্ঘ জীবনে কত মানুষকে কাছ থেকে দেখেছি। কেউ রাজনীতিক তো কেউ গাইয়ে, কেউ লেখক তো কেউ অভিনেতা। তাদের পেশাগত জীবনকে যেমন জেনেছি, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনের নানা অনুভূতিও উঠে এসেছে। খুব যে সিরিয়াস আলোচনা বা সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, এমন নয়। নিছক আড্ডাতেও উঠে এসেছে কত প্রসঙ্গ। যার অনেকটাই ছাপার হরফে কোনওদিন দিনের আলো দেখেনি।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেক কথাই যে ভুলে যাচ্ছি, এটাই বা অস্বীকার করি কী করে! টুকরো টুকরো সেই মুহূর্তগুলো তো ডায়েরিতে লিখেও রাখিনি। যেমন, মাঝে মাঝেই হুটহাট করে চলে আসত। ফিরত সেই বিকেলবেলায়। আবার কখনও সন্ধেবেলায় হাজির হয়ে আড্ডা দিত রাত বারোটা পর্যন্ত।
একেকদিনের কথা লিখে রাখতে গেলেই আস্ত একটা বই হয়ে যায়। এই ধারাবাহিক কলমে তার কিছু কথা লিখেছি। এক কথা বারবার লিখতে ইচ্ছে করে না। এবার বলি আমার ছেলের বিয়ের প্রসঙ্গ। ওর মতো বন্ধুকে নেমন্তন্ন করব না, তা তো হতে পারে না। কিন্তু এটাও জানি, নেমন্তন্ন করলেও সে আসবে না। যে কোথাও যায় না, যে বহির্জগতের সঙ্গে সব সম্পর্কই প্রায় চুকিয়ে দিয়েছে, সে বিয়েবাড়িতে কেন আসতে যাবে! তাছাড়া, আসার জন্য তাকে জোরাজুরিও করা যায় না। তবু সবাইকে চমকে দিয়েই সে এল। তবে বউভাতের দিন নয়। এল বউভাতের আগের রাতে। আমার বউমাকে একটা দামি শাড়ি দিয়ে গেল। সেদিন বাড়িতে কিছু লোকজন ছিল। সুচিত্রা সেন বাড়িতে এলে আত্মীয়দের একটা কৌতূহল থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই তাদের বারণও করা যায় না। আবার সুচিত্রাকে কেউ অহেতুক বিরক্ত করুক, সেটাও চাইছিলাম না। কারণ, সেটাও তার কাছে অস্বস্তিকর। সেই রাতে সুচিত্রা বেশিক্ষণ ছিল না। আশীর্বাদ করেই চলে গিয়েছিল।
বউভাতের দিন দেখলাম, ঘুরেফিরে সেই একটাই আলোচনা। কী পরে এসেছিল, এখন দেখতে কেমন, কী খেয়েছিল, কী বলে আশীর্বাদ করল, ছবি তোলা হল কিনা, এই নিয়েই সবার যত আগ্রহ। কেউ কেউ আশা করছিল, আবার যদি সুচিত্রা এসে যায়! না, সেই রাতে আর আসেনি। আসার কথাও ছিল না।
বিয়েবাড়ির পাট চুকতে আমার স্ত্রী আর নতুন বউমাকে নিয়ে গেলাম সুচিত্রার বাড়ি। সে তো কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়বে না। আপ্যায়ন বলে আপ্যায়ন। কোনও আয়োজনই বাকি রাখেনি। সারাক্ষণ নিজে তদারকি করল, আমরা ঠিকঠাক খাচ্ছি কিনা। অথচ, নিজে প্রায় কিছুই খেল না। আসলে, খাওয়ায় ওর তেমন রুচি নেই। ও খাইয়ে আনন্দ পায়। সেই দিন আমার বউমার সঙ্গে অনেক গল্প করেছিল। আমার বউমা তো আপ্লুত। একে সামনে সুচিত্রা সেন, তার ওপর এত গল্প, ও যেন ঠিক বিশ্বাস করতেই পারছিল না।
হঠাৎ হঠাৎ ও এসে পড়ত। বলত, খেয়ে যাব। নামেই খাওয়া। আসলে, সারাক্ষণ আড্ডা দিয়ে বিকেলে চলে যেত। একবার বেলার দিকে হঠাৎ হাজির। বলল, আজ আমি তোমার বাড়িতে আড্ডা দেব। কিন্তু আমার তো অফিস আছে। ও বলল, তুমি অফিস যাও, তোমাকে তো বারণ করিনি। আমার স্ত্রী তখন নিজের কর্মক্ষেত্রে বেরিয়ে গেছে। তাকে ডেকে পাঠানো হল। সে ফিরে এসে রান্না করল। এদিকে আমি পড়লাম মহা সমস্যায়। সুচিত্রাকে বাড়িতে রেখে অফিস যাই কী করে! বিকেল পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে চলে গেল। আবার কখনও ওর বাড়িতে আমার ডাক পড়ত। গেলেই নানারকম খাওয়ার আয়োজন। আর ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেট। কত গল্প, কত আড্ডা। কেন যে আমাকে পছন্দ করত, আমি নিজেও বুঝতাম না। বোঝার চেষ্টাও করতাম না। যদি আমাকে একটু বেশি ভরসা করেও থাকে, এর পেছনে কারণ খোঁজা উচিত নয়। অথচ, সাড়ে চুয়াত্তর ছাড়া ওপর কোনও ছবিই আমি দেখিনি। মাঝে মাঝে ওকে বলেওছি সে কথা। ও বলত, না দেখে ভাল করেছ। এই তো সামনে থেকেই দেখছ। আসলে, ও আশপাশে যাদের দেখেছে, তারা অনেকেই ওর ছবি দেখে তা নিয়ে নানা প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছে। সেই প্রশংসার মধ্যে কোথাও যেমন সত্যতা ছিল, তেমনি কোথাও ছিল খুশি করার চেষ্টা। এত স্তাবককে দেখেছে, তাই প্রশংসা শুনলেই মনে হত, হয়ত বানিয়ে বলছে। আমি সে সব বলতাম না। ওর সিনেমা নিয়ে তেমন আলোচনাই করতাম না। তাই হয়ত বাকিদের থেকে আমাকে কিছুটা আলাদা নজরে দেখত।
একদিন ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি তাহলে সত্যি সত্যিই গ্রেটা গার্বো হয়ে গেলে! ও বলত, ‘ওসব গার্বো–টার্বো বুঝি না। আমি আমার মতো আছি। আসলে তুমি যদি প্রণয়পাশা দেখতে, তাহলে বুঝতে পারতে। একেবারেই অভিনয় করতে পারিনি। মনে হয়েছে, আর পারছি না। তাই সরে যাওয়াই ভাল।’ আসলে, ও চেয়েছিল, যে সুচিত্রাকে লোকে সেলুলয়েডের পর্দায় দেখেছে, সেই সুচিত্রার ছবিটাই মানুষের মনে থাকুক। বয়স্ক সুচিত্রার মুখটা দেখাতে চায়নি। এমনকি চেনা মানুষদেরও দেখাতে চায়নি। তাই অন্তরালকেই বেছে নিয়েছে। মাঝে মাঝে ভাবি, একজন মানুষ এত বছর ধরে এমন সংযম ধরে রাখে কী করে!