মাঝে মাঝেই কাজের সূত্রে কলকাতায় যেতে হয়। কখনও বাসে ফিরি। আবার অনেক সময় ট্রেনেও ফিরতে হয়। কিন্তু ট্রেনে ফিরতে গিয়ে যে ভোগান্তির শিকার হতে হয়, তা জানানোর জন্যই এই চিঠি। আমার ধারণা, আমার মতো অনেককেই এমন হয়রানির শিকার হতে হয়।
হাওড়ায় টিকিট কাটা মানে বিরাট এক যন্ত্রণা। বেশ কয়েকটি মেশিন বসানো হয়েছে। যাতে স্মার্টফোন দিয়ে টিকিট কাটা যায়। এটাকে যদি উন্নতি বলেন, তাহলে উন্নতি। কিন্তু আমার মতো অনেকেই আছেন, যাঁরা স্মার্টফোন ব্যবহারে ততখানি সড়গড় নন। যাঁরা অনলাইনে টিকিট কাটতে পারেন না। তাঁদের ভরসা ওই টিকিট কাউন্টার।
যেদিকে টিকিট কাউন্টার, অনেকে খুঁজেই পাবেন না। একে তাকে জিজ্ঞাসা করে হয়তো পৌঁছনো গেল। গিয়ে দেখা যাবে, প্রায় কুড়িখানা কাউন্টার। কিন্তু খোলা আছে তিনটি বা চারটি। বেলার দিকে হয়তো আরও কয়েকটি খোলা হয়। কিন্তু সকালের দিকে অনেকবারই দেখেছি, দুটো বা তিনটে কাউন্টার খোলা। এদিকে প্রচুর যাত্রী। ফলে, লাইন বাড়তেই থাকে। একেকটি লাইনে অন্তত পঞ্চাশ–ষাট জন যাত্রী দাঁড়িয়ে। লাইন এগিয়ে চলেছে মন্থর গতিতে। এরই মাঝে অনেকে লাইন না দিয়েই নানা কায়দা করে ঠিক লাইনে ঢুকে পড়েন। ফলে, লাইন আর এগোতেই চায় না। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর পর কাউন্টারে পৌঁছতে ৩৫–৪০ মিনিট লেগে যায়।
শুনলে হয়তো বাড়াবাড়ি মনে হবে। কিন্তু সকালের দিকে যাঁদের লাইন দিয়ে টিকিট কাটার অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা ভুক্তভোগী। যদিওবা কাউন্টারে পৌঁছলেন, খুচরো নিয়ে নানা সমস্যা। আপনার টিকিটের ভাড়া হয়তো পনেরো টাকা। আপনি কুড়ি টাকার নোট দিলেন। কিন্তু উল্টোদিকে নাকি পাঁচ টাকা খুচরো নেই। বলা হবে, খুচরো করিয়ে আনুন। এমনও হয়েছে, টিকিটের দাম ৯০ টাকা। আপনাকে ৯০ টাকাই খুচরো দিতে হবে। যিনি কাউন্টারে থাকবেন, তাঁর দশ টাকা দেওয়ার কোনও দায় নেই। ফলে, তর্কাতর্কি চলতে থাকে। লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।
আচ্ছা বলুন তো, এত ঝক্কি সামলানোর পর লোকে টিকিট কাটবে কেন? ১) আপনাকে অন্তত আধঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হবে। ২) টিকিটের টাকা তো গেলই। ৩) কাউন্টারের সামনে খুচরো নিয়ে সমস্যা। ৪) দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর ফলে হয় ট্রেন ছেড়ে চলে গেল। ৫) যদিও বা ট্রেন পেলেন, বসার সিট পেলেন না। ৬) ট্রেনে উঠে দেখলেন কোনও টিটিও এলেন না।
যদি টিকিট না কাটার সিদ্ধান্ত নিতেন, তাহলেই বা কী হত? ১) এতক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হত না। ২) টিকিটের টাকাও বেঁচে যেত। ৩) খুচরো নিয়েও সমস্যায় পড়তে হত না। কাউন্টারে গিয়ে রেলকর্মীর মেজাজ শুনতে হত না। ৪) ট্রেনও মিস হত না। ৫) আগে পৌঁছে জানালার ধারে সিটও পেতেন। ৬) টিটিও নেই, ফলে ফাইন দেওয়ার আশঙ্কাও নেই। ৭) কুড়ি দিনের মধ্যে উনিশ দিন বিনা টিকিটেই গেলেন। একদিন হয়তো ফাইন হল। গায়ে লাগবে না। একদিন ফাইন দিয়ে যদি কুড়িদিন নানা বিধ ভোগান্তি থেকে মুক্তি পান, মন্দ কী?
টিকিট না কাটার পক্ষে যেসব যুক্তিগুলো তুলে ধরলাম, তার কোনওটাই কাম্য নয়। কিন্তু একজন যাত্রীকে যদি টিকিট কাটতে গিয়ে ক্রমাগত এমন ঝক্কিঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তাঁর মনে এই প্রশ্নগুলো উঠতে বাধ্য। এরপরেও মানুষ টিকিট কাটেন। এটা সেই যাত্রীর মহানুভবতা। যাত্রীরা এত মহানুভবতা দেখাবেন, রেল যদি একটু মহানুভবতা দেখাত! বেশি কিছু নয়, কাউন্টারে লোকের সংখ্যা তো বাড়ানো যায়। টিকিট কাটতে যে আধঘণ্টা দাঁড়াতে হয়, সেটাকে তো দশ–বারো মিনিটে নামিয়ে আনা যায়। একটু সদিচ্ছা থাকলেই যায়। এত হাজার হাজার যাত্রীর ভোগান্তি দেখে রেল কি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে আরও একটু সচেতন হতে পারে না?