কিছুটা নিঃশব্দেই চলে গেলেন ইদ্রিশ আলি। পোশাকি পরিচয় তৃণমূলের বিধায়ক, প্রাক্তন সাংসদ। পেশায় আইনজীবী। বরাবরই বেশ বিতর্কিত। অবশ্য, কিছু বিতর্ক ইচ্ছে করেই ডেকে আনতেন। স্রেফ খবরে থাকার জন্য। খবরে থাকার একটি অভিনব পন্থা ছিল। তাঁর স্মরণে সেদিকেই আলো ফেললেন সরল বিশ্বাস।।
সময়টা সেই নয়ের দশক। তখনও বাঙালির জীবনে টিভি বলতে সবেধন নীলমণি দূরদর্শন। আর খবর বলতে, সন্ধে সাড়ে সাতটা আর রাত দশটা কুড়ির বাংলা সংবাদ। রেডিও–তে অবশ্য স্থানীয় সংবাদ ছিল। তখনও কাগজে একলাইন খবর মানে, দারুণ একটা ব্যাপার।
টিভির খবরে প্রায়ই একটা নাম শোনা যেত, ইদ্রিশ আলি। তখন তিনি ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেসের সংখ্যালঘু সেলের সাধারণ সম্পাদক। একে প্রদেশ কংগ্রেস। তার আবার সংখ্যালঘু সেল। তার আবার সাধারণ সম্পাদক। অনেকটা পালংশাকের ক্যাশমেমোর মতোই। কিন্তু তিনি নিয়মিত প্রচারের আলোতেই থাকতেন।
আসলে, রোজই কোনও না কোনও একটা বাহানায় তিনি চিঠি লিখতেন। যাকে তাকে নয়, একেবারে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে। বিচিত্র সব বিষয়। কোনওদিন হয়তো ঈদের শুভেচ্ছা জানাতেন। কোনও দিন ইরাকে বোম পড়লে শোক জানাতেন। কোনওদিন মধ্যপ্রদেশে ট্রেন দুর্ঘটনা হলে তদন্ত চাইতেন। কোনওদিন কর্ণাটক আর তামিলনাড়ুর মধ্যে নদীর জলবন্টন সমস্যার দ্রুত সমাধান চাইতেন।
আচ্ছা, ইরাকে বোম পড়লে জ্যোতি বসু কী করবেন? মধ্যপ্রদেশে ট্রেন দুর্ঘটনা হলেই বা জ্যোতি বসুর কী করার আছে? কিন্তু ইদ্রিশ আলিকে সেটা কে বোঝায়? তাঁকে নিত্যনতুন বিষয় নিয়ে চিঠি লিখতেই হবে। যাকে তাকে চিঠি লিখলে খবর হবে না, অতএব মুখ্যমন্ত্রী। সব বিষয়েই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করতেন।
জ্যোতি বাবু সময় পেলে রাতে দূরদর্শনের বাংলা খবর শুনতেন। কখনও কখনও রেডিওর স্থানীয় সংবাদও শুনতেন। সকালে কাগজেও চোখ বোলাতেন। প্রায়ই দেখতেন, তাঁকে কোনও এক ইদ্রিশ আলি নাকি চিঠি লিখেছেন। কিন্তু সেই চিঠি কোনওদিনই হাতে আসত না। লোকটা আসলে কে? তাঁর মনেও কৌতূহল তৈরি হল।
একদিন প্রদেশ কংগ্রেসের একটা প্রতিনিধি দল জ্যোতি বসুর কাছে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে ডেপুটেশন দিতে গেল। সেই দলে সম্ভবত ছিলেন সোমেন মিত্র, অতীশ সিনহা, মানস ভুঁইয়া, আব্দুল মান্নানেরা। হঠাৎ, জ্যোতি বাবু জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা, আপনাদের কে একজন নেতা আছেন, রোজ আমাকে নাকি চিঠি লেখেন। কই, আমি তো কোনও চিঠি পাই না।’
সোমেনবাবুরা তখন এর–ওর মুখ চাওয়া–চাওয়ি করছেন। জ্যোতি বাবু কার কথা বলছেন, অনেকে বুঝতেও পারছেন না। তখন কোনও একজন বললেন, ‘আপনি কি ইদ্রিশ আলির কথা বলছেন?’ জ্যোতিবাবুর হঠাৎ করে নামটা মনে পড়ে গেল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওই কী একটা আলি। টিভিতে শুনি আমাকে চিঠি লিখেছেন। কাগজেও দেখি, চিঠি লিখেছেন। আমি খোঁজ নিয়েও দেখেছি। কই, কোনও চিঠি তো আসেনি। ওঁকে একবার নিয়ে আসবেন তো।’
আসলে, ইদ্রিশ আলি প্রথম হয়তো চিঠি পাঠাতেন। কিন্তু তা জ্যোতু বসুর টেবিল পর্যন্ত পৌঁছতো না। পৌঁছনোর কথাও নয়। মুখ্যমন্ত্রীর ঠিকানায় তো এমন প্রচুর চিঠি আসে। সব চিঠি তো আর তাঁর টেবিলে যায় না। সচিবালয়েরই কেউ হয়তো দেখতেন। বাছাই করা কিছু চিঠি মুখ্যমন্ত্রীকে দেখাতেন। বাকিগুলো ফেলে দিতেন। তাঁর হয়তো মনে হত, এসব উল্টো পাল্টা চিঠি মুখ্যমন্ত্রীকে দেওয়ার মানেই হয় না।
এদিকে, ইদ্রিশ আলির তো মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়া উদ্দেশ্য নয়। তিনি জানেন, মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখলে খবর হবে, তাই লেখেন। তারপর সেগুলো জেরক্স করিয়ে পরিচিত সাংবাদিকদের বিলি করতেন। তাতেই খবর হয়ে যেত। খবর যখন হয়ে যাচ্ছে, তখন আর মুখ্যমন্ত্রীকে পোস্ট করার দরকার কী! মাঝে মাঝে সাংবাদিকদের বিরিয়ানি খাওয়ালেই হল। এটা–ওটা উপঢৌকন দিলেই হল। পরের দিকে হয়তো চিঠি লিখতে পারতেন না। পরিচিত সাংবাদিকদের ফোন করেই বলতেন, ‘আজ মুখ্যমন্ত্রীকে এই বিষয়ে চিঠি লিখলাম। একটু দু–লাইন খবর করে দিও ভাই।’ সেই খবরও হয়ে যেত।
অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি এলই না। কিন্তু খবর হয়ে গেল। পরের দিকে, চিঠি লেখাও হল না, কিন্তু চিঠি লিখেছেন, খবর হয়ে গেল।
হ্যাঁ, এভাবেই খবরে ভেসে থাকতেন ইদ্রিশ আলি। খবরে থাকতে কত চিঠি যে লিখেছেন। ঠিকঠাক জমিয়ে রাখতে পারলে হয়তো গিনেস বুকে নামও উঠে যেত। আজ যখন চিঠি লেখা একরকম হারিয়েই গেছে, তখন ইদ্রিশ আলির মতো কেউ তো ছিলেন, যিনি খবরে থাকতে চিঠিতেই ভরসা রেখেছিলেন।