ক্যাপ্টেন, দেখা হবে তোমায় আমায় অন্য গানের ভোরে

সরল বিশ্বাস

শুরুতেই স্বীকার করে নেওয়া ভাল, ‌আমি কখনও ব্রিগেড যাইনি।

অনেকবার যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। ট্রেনে–‌বাসে খুব ভিড় হয়, এমনটাও জানি। হয়তো সেই কারণেই ইচ্ছে থাকলেও সাহসে কুলিয়ে ওঠেনি। মনে হয়েছে, এত ধকল পোশাবে না।

একটা মন বলত, একবার অন্তত যাওয়া দরকার। অমনি, আরেকটা মন বলে উঠত, গিয়ে কী হবে!‌ নেতারা কী আর নতুন কথা বলবেন!‌ সেই তো একই ভাষণ। এগুলো ইউটিউবে কত শুনেছি।

এবার কেন জানি না, বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই নিজের মনকে তৈরি করছিলাম। মনে হচ্ছিল, এবার যেতেই হবে। এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে একদিন আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম কলকাতার শহরতলিতে। এক আত্মীয়ের বাড়িতে। ঠিক কলকাতা নয়, একটু দূরে। কিন্তু আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছেও যাওয়া যায়।

শহরতলির ট্রেন ধরে দমদম। সেখান থেকে মেট্রোয় ময়দান। সেভাবেই পৌঁছে যাওয়া। কিছুটা আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম।

শীতের রোদ গায়ে মেখে, ময়দানে ঘুরতে মন্দ লাগছিল না। কত দূরদূরান্ত থেকে আসা কত হাজার হাজার মানুষ। কোচবিহারের মাঝবয়সীর সঙ্গে কী অবলীলায় গল্প জুড়ে দিয়েছে পুরুলিয়া থেকে আসা তরুণ। বর্ধমান থেকে আসা চাষি আর নদিয়ার কলেজ ছাত্রের মধ্যেও চলছে নানা মত বিনিময়।

একমনে শুনছিলাম। অদ্ভুত একটা ভাল লাগা যেন কাজ করছিল। এরা কেউ কাউকে চেনে না। এই মাঠেই আলাপ। তবু ফোন নম্বর বিনিময় হচ্ছে। একে অন্যের সঙ্গে ছবি তুলছে। একে অন্যের এলাকার খোঁজ নিচ্ছে। কী করলে দলের ভাল হয়, কী করলে রাজ্যের ভাল হয়, সেই বিষয়ে দু’‌জনে নিজের নিজের মতো করে মতামত দিচ্ছে। কোথাও সেই মত মিলছে। আবার কোথাও একটু অমিলও থাকছে।

মনে হচ্ছিল, কোন আত্মীয়তার বন্ধন এদের এভাবে একে অন্যের সঙ্গে বেঁধে দিল!‌ কী অবলীলায় কেউ একে অন্যকে ‘‌কমরেড’‌ বলছে। কেউ আবার বয়স্ক কমরেডকে কাকু বলেও সম্বোধন করছে। জলপাইগুড়ির সেই তরুণ কী অবলীলায় মেদিনীপুরের আরেক যুবককে ফোন নম্বর দিয়ে বলছে, ডুয়ার্সে এলে আমাদের বাড়িতে এসো কিন্তু। কোনও হোটেলে থাকতে হবে না। আমি তোমাদের জঙ্গলে ঘোরাবো।

হ্যাঁ, এটাই ব্রিগেডের মাহাত্ম্য। ওরা সবাই জানে, ওরা শেষ দুটো নির্বাচনে শূন্য। এই লোকসভাতেও বিরাট কিছু মিরাক্যাল ঘটে যাবে, এমন দিবাস্বপ্নও কেউ দেখছে না। ঘটলেই বা ওদের কী!‌ ওরা তো মন্ত্রী হবে না, বিধায়কও হবে না, নিদেনপক্ষে পঞ্চায়েত মেম্বারও হবে না। তবু লাল পতাকার প্রতি অদ্ভুত এক ভালবাসা।

আচ্ছা, আমি কেন এসেছি!‌ আমি তো আর সে অর্থে সিপিএম করি না। মিছিলেও হাঁটি না। পাড়াতেও বিরাট কিছু বিপ্লব করি, এমন অভিযোগ নেই। কেউ রাজনীতি নিয়ে তর্ক করলে বরং কিছুটা গা বাঁচিয়েই চলি। বাবা–‌কাকারা এই দলটাকে ভালবাসে। এই দলটা কোথাও জিতলে ভাল লাগে। হারলে কষ্ট পাই। এই তো। এর বেশি তো কিছু নয়।

আমি কী এমন দায়িত্ব পালন করি!‌ বলতে গেলে, কিছুই না। ফেসবুকে নানা ছবি আসে, লেখা আসে। ভাল লাগলে পড়ি। দু একজনকে পাঠাই। কোথাও লাল পতাকার মিছিল দেখলে, সেই মিছিলে মানুষের সমাগম দেখলে মনে বল পাই। টিভিতে বামেদের কেউ কিছু বললে, মন দিয়ে শুনি। কথাটা মনে ধরলে বন্ধুদের আড্ডায় দু–‌একজনকে বলি। এই তো। এর বেশি তো কিছু নয়।

কেন জানি না, এই মীনাক্ষী নামের মেয়েটাকে বেশ লাগছে। মেয়েটা সত্যিই লড়াকু। মফস্বল থেকে উঠে আসা। কথার মধ্যে একটা হালকা হিন্দি মেশানো টান আছে। আটপৌরে পোশাক। আটপৌরে ভাষা। সুন্দরভাবে মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে। তেমন দেখনদারি নেই। টিভি স্টুডিওতেও দেখি না। মেয়েটা আজ কোচবিহার, কাল মালদা, এই করে বেড়াচ্ছে। টানা দু মাস ধরে আড়াই হাজার কিলোমিটার হাঁটা কি চাট্টিখানি কথা!‌ এই মেয়েটা করে দেখিয়েছে।

মনে হল, মেয়েটা যখন এত লড়াই করছে, ওর দুটো কথা একটু শুনে আসি। তাই তো আসা।

বাড়িতে থাকলেই বা কী করতাম!‌ হয়তো ফেসবুকে চোখ রাখতাম। হয়তো কোনও ওয়েব সিরিজ দেখতাম। এমন কত দিন এমন অপচয়েই পেরিয়ে যায়। কী করলাম, পরের দিন আর মনেও থাকে না।

কিন্তু এই ব্রিগেডের কথা!‌ অনেকদিন মনে থাকবে। এই ব্রিগেড থেকে একবুক অক্সিজেন নিয়ে ফিরলাম। মনে হল, দিনটা সার্থক। এলাকার কোনও মিটিং বা মিছিলে হয়তো এরপরেও আমাকে দেখা যাবে না। চায়ের দোকানের তর্কেও হয়তো গুটিয়েই থাকব। তবু মনে মনে এই দলটাকে যেন আরও একটু ভালবেসে ফেললাম।

মীনাক্ষীকে সবাই দেখলাম ‘‌ক্যাপ্টেন’‌ বলছে। আমারও খুব বলতে ইচ্ছে করছে। ক্যাপ্টেন, লাল সেলাম।

হাল ছেড়ো না বন্ধু
বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে
দেখা হবে তোমায় আমায়
অন্য গানের ভোরে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.