সৌর্য মিত্র
কলকাতায় তখন তীব্র দাবদাহ। মনটা কেমন পাহাড় পাহাড় করছিল। তবে শহরের কোলাহল নয়। চেয়েছিলাম, নির্জন কোনও পাহাড়ি গ্রামে যেতে। ইউটিউব জমানায় এখন পাহাড়ি গ্রাম খুঁজে নেওয়া অনেক সহজ। কিন্তু তাতে বিভ্রান্তিও কম নেই। কোনটা ছেড়ে কোনটায় যাব! আমাদের গন্তব্য ছিল পূর্ব সিকিমের একটি ছোট্ট গ্রাম, নাম পাস্টিং। কীভাবে এই গ্রামের সন্ধান পেলাম! স্টার হলিডেস এর সৌজন্যে। শুরুতেই মুক্তকণ্ঠে ঋণস্বীকার করে নেওয়া দরকার। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে পাস্টিং মোটামুটি ঘণ্টা চারেকের পথ। রংপো, রংলি ও লিংথাম হয়ে অবশেষে আমরা পাস্টিংয়ে পৌঁছলাম।
এই দীর্ঘ যাত্রার অনেকটা সময় ধরেই আমাদের সঙ্গিনী ছিলেন তিস্তা নদী। যাত্রাপথে তার সান্নিধ্যও কম উপভোগ্য নয়। পাহাড় ঘেরা একটি অজানা গ্রামের মাঝে এত সুন্দর একটি হোমস্টে দেখে আমরা তো আনন্দে আত্মহারা।
ঘর গুলিও সুসজ্জিত এবং পরিষ্কার। সকালের প্রাতরাশ রাস্তাতেই সেরে ফেলেছিলাম। হোম স্টে–তে সুস্বাদু মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম পদব্রজে গ্রামের চার পাশটা দেখতে। আমাদের পথপ্রদর্শক ছিলেন এই হোমস্টেরই কর্মী জিবনজি। চারদিক ঘেরা পাহাড়ের মাঝে একটি ছোট্ট রাস্তা দিয়ে আমরা জিবনজি–কে অনুসরণ করে এগিয়ে চললাম কারবারি খোলার দিকে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, জায়গাটার নাম হঠাৎ কারবারি খোলা কেন? শোনা গেল, এখানকার রাজার আমলে এই ছোট্ট নদীর তীরে কারোবার বা ব্যবসা হত, সেখান থেকেই এই নাম।
হিমেল মৃদু হাওয়া উপভোগ করতে করতে এবং অজানা সব পাখির কলতান শুনতে শুনতে আমরা এগোতে থাকলাম। মিনিট দশেক হাঁটার পরই কানে এল নিচে বয়ে যাওয়া নদীর জলের কলকল শব্দ।
সেই শব্দ অনুসরণ করে আমরা এসে পৌঁছলাম একটি ঝুলন্ত সেতুর উপর। নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে কারবারি খোলা। সেতুর ওপর কিছুটা সময় কাটিয়ে আমরা নিচে নদীর ধারে গিয়ে বসলাম। সব কিছু ভুলে প্রকৃতি ও পাহাড়ের মাঝে আমরা প্রায় হারিয়েই গিয়েছিলাম।
পাহাড়ে ঝুপ করে সন্ধে নেমে আসে। হঠাৎ করে জাঁকিয়ে ঠান্ডাও পড়ে যায়। তবু এমন আবহ ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, অনন্ত সময় বসে থাকি। কিন্তু আমাদের সঙ্গে ছিলেন জীবনজি। তাঁর কী বিড়ম্বনা, একবার ভাবুন তো। আমরা না হয় নদী, পাহাড় দেখে রোমাঞ্চিত হচ্ছি। কিন্তু তাঁর কাছে তো ঘর কা মুরগি ডাল বরাবর। তিনি তো রোজ এসব দেখেই অভ্যস্থ। তাঁর রোমাঞ্চ জাগবে কেন? আমাদের জন্য তাঁকেও খামোখা বসে থাকতে হচ্ছে। তাঁর বিরক্ত হওয়ার স্বাভাবিক ছিল। তবু মুখে হাসিটি লেগেই আছে। এক ফোঁটা বিরক্তি নেই। ফেরার পথে শুনলাম, রাতের দিকে এখানে মাঝে মধ্যেই ভালুক বা রেড পান্ডা দেখা যায়। শুনে রোমাঞ্চ এল। ভয়ের চোরাস্রোতও কি এল না!
পাহাড়ি পথ হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের হোমস্টে–তে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল গরম চা, সঙ্গে পপকর্ন। বারান্দায় বসে মেঘ ও পাহাড়ের খেলা দেখতে দেখতে কখন আঁধার নেমে এল বুঝতেই পারলাম না। একটু একটু করে তারা ফুটছে। মনে হচ্ছে, তারাগুলো যেন জোনাকির মতো জ্বলে উঠছে। কতদিন এমন পরিষ্কার আকাশ দেখিনি। এরই মধ্যে জিবনজি আমাদের ডাকতে এলেন বন ফায়ারে যোগদান করতে। পাহাড়ের মাঝে বন ফায়ার, তার সঙ্গে স্থানীয় কচি কাঁচাদের নৃত্য পরিবেশন, এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
অনুষ্ঠানের পর নৈশভোজের পর্বটা একটু আগেই সেরে ফেললাম। আমাদের প্রচলিত রুটিনে, আমরা একটু রাতের দিকে খেতে অভ্যস্থ। কিন্তু এখানকার রুটিনে সেই রাতটা প্রায় মধ্যরাত। যস্মিন দেশে যদাচার। তাছাড়া, রাত বাড়লে ঠান্ডাও বাড়ে। বাইরে কতক্ষণই বা বসে থাকব! তাই একটু দ্রুতই ঘুমের দেশে যেতে হল। পরদিন সকালে ঠিকানা বদল জুলুক, নাথান ভ্যালি ও ছাঙ্গু লেকের পথে বেরিয়ে পড়া। কিন্তু পাস্টিংয়ের সেই টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলোও ভোলার নয়।