(সময়টা ২০১৪। মে মাস। সূর্য যেন চোখ রাঙাচ্ছে। বাইরে প্রচণ্ড লু বইছে। তার মাঝেই তিনি চষে বেড়াচ্ছেন জঙ্গল মহল। ৯ বারের সাংসদ। সেবার হেরে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে কাটানো কিছু মুহূর্ত নিয়েই তৈরি হয়েছিল একটি প্রতিবেদন। প্রয়াত বাসুদেব আচারিয়ার স্মরণে সেই লেখা ফিরিয়ে আনা হল। )
স্বরূপ গোস্বামী
ঘরের ঠিকানা প্রায় ভুলেই গেছেন। পার্টি অফিসের দোতলায় ছোট্ট একটি ঘর। প্রায় দু’মাস হল, সেটাই তাঁর ঠিকানা। বেরিয়ে পড়ছেন সেই সাতসকালে। কাছেপিঠে থাকলে দুপুরের দিকে ফিরছেন। ঘণ্টা দুই বিশ্রামের পর রোদ থাকতে থাকতেই ফের বেরিয়ে পড়া। তবে অধিকাংশ দিনই সে সুযোগ হয় না। দুপুরে কোনও গ্রামে কোনও পার্টি কর্মীর বাড়িতেই টুকটাক কিছু খেয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ানো। যখন ফেরেন, বাঁকুড়া শহরের রাস্তাঘাট শুনশান হয়ে যায়। ফিরে এসেও কি শান্তি আছে? টিভিতে চোখ বোলানোর ফাঁকে ফাঁকেই একের পর এক ফোন। একফোঁটা বিরক্তি নেই। পরেরদিন সাত সকালে চিড়ে দই খেয়ে আবার নতুন উদ্যমে বেরিয়ে পড়া। কে বলবে বয়স বাহাত্তর !
রবিবার পৌঁছলাম বাঁকুড়া। সঙ্গী কলকাতা থেকে নির্বাচন কভার করতে আসা এক সাংবাদিক (কলেজ-ইউনিভার্সিটির এক ব্যাচ সিনিয়র দাদা)। সেদিন বাসুদেব আচারিয়ার প্রচার ছিল বাঁকুড়ার আশেপাশে। চাইলে সেই দুপুরে বা রাতেই কথা বলা যেত। কিন্তু শুনলাম, পরেরদিন সকাল থেকে রানিবাঁধ ঝিলিমিলি। মনে হল, পার্টি অফিসের ঘেরাটোপে নয়, জঙ্গলমহলের একের পর এক প্রত্যন্ত গ্রামে নতুন করে চেনা যাবে ন’বারের সাংসদকে। রবিবার দুপুরে বলেই ফেললাম, কাল তো আপনার সারাদিন জঙ্গলমহল সফর। আজ নয়, আমরা বরং কালকেই কথা বলব। অনেক ফাঁকা সময় পাওয়া যাবে। শিশুর সরলতা নিয়ে বাসুদেব আচারিয়ার উত্তর, ‘আপনারা জঙ্গলমহল যাবেন? বাহ্, তাহলে তো খুব ভাল হয়। ওখানকার আসল ছবিটাও দেখতে পাবেন । তারপরই বললেন, ‘আমি কিন্তু ঠিক সাতটায় বেরিয়ে যাব।’
যতই বলুন সাতটা। আফটার অল বাঙালি তো। সাতটা মানে নিশ্চয় সাড়ে সাতটা হবে। আমাদের গাড়ি পার্টি অফিস পৌঁছতে সাতটা দশ। গিয়ে শুনলাম, একটু আগেই বেরিয়ে গেছেন। এখন কোথায় খোঁজা যায়! ধাওয়া করলাম পিছু পিছু। ফোন করাই যেত। মনে হল, আগে রানিবাঁধ পার্টি অফিস যাওয়া যাক। ওখানে ঠিক পাওয়া যাবে। সাড়ে আটটা নাগাদ সেখানে পাওয়া গেল। মন দিয়ে কাগজ পড়ছেন। দলের দুজন, আমরা দুজন, সর্বসাকূল্যে চারজন। চা এল। টুকটাক গল্পও চলতে লাগল। জোনাল সম্পাদক এখানে সেখানে ফোন করে প্রস্তুতির খোঁজ নিতে লাগলেন। চা সহযোগে টুকটাক আড্ডা। মাপা কথা নয়, বরং খোলা মনেই নানা প্রসঙ্গ টেনে আনলেন। সব কথা লেখার নয়, তাই কিছু কথা আড়ালেই থাক।
সকাল সাড়ে নটা । রানিবাঁধ পার্টি অফিস থেকে বেরোলো দুটো গাড়ি। একটা বাসুদেব আচারিয়ার। আরেকটা আমাদের। পৌনে দশটা নাগাদ পোড়াডি মোড়। হঠাৎ দেখা গেল, জলপাই রঙের পোশাক পরা কিছু পুলিশ। পেছনে ধামসা মাদলের শব্দ। দূর থেকে একটা মিছিল এগিয়ে আসছে। আমরা তখন একটা চায়ের দোকানে। বাসুবাবু না হয় চিড়ে দই খেয়ে বেরিয়েছেন, আমাদের তো কিছুই জোটেনি। সারাদিন জুটবে, এমন গ্যারান্টিও নেই। তাই শৌখিন জলখাবার নয়, মুড়ি-চপ নিয়ে বসলাম। বাসুদেববাবু তখন রাস্তার ওপারে। দোকানি যুবকের চোখ বাসবাবুর দিকে। এক পার্টি কর্মীর কাছে আবদার, ‘দাদা, যাও না, একটু বাসুবাবুকে এই দোকানে এনে বসাও। একটু পায়ের
ধুলো পড়ুক। নিজের হাতে মানুষটাকে একটু চা খাওয়াই।’ বাসুবাবু এলেন দোকানে। মুড়ি- চপ দেখেই সহাস্য মন্তব্য, ‘এটাই হল বাঁকুড়ার আসল খাবার। ঠিক জিনিসটাই বেছেছেন। দোকানি যুবক তখন পরম যত্নে চা করছেন সাংসদের জন্য। আবেগে, উত্তেজনায় কবার চিনি দিলেন (বা দিতে ভুলে গেলেন কিনা) কে জানে! ছোট্ট একটা মিছিল এগিয়ে চলল ঝিলিমিলির দিকে। ছোট ছোট কিছু জনপদ। সামনে বাসুদেব আচারিয়া। পেছনে জনতা। হাতজোড় করে চলেছেন প্রার্থী। আদিবাসী ঘরের দাওয়া থেকে আসছে পাল্টা হাসি৷ প্রতি নমস্কারের পোশাকি সৌজন্য অনেকে জানে না। ওই হাসিটা তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এক বৃদ্ধ কাছে আসবেন কিনা সঙ্কোচ করছিলেন। যদি কেউ দেখে ফেলে। এদিক ওদিক তাকিয়ে, ভয়-ভীতি ভুলে সটান এসে দাঁড়ালেন প্রার্থীর সামনে। মুখে না বলা অনেক কথা। বুঝে নিতে ভুল হল না ৩৪ বছরের সাংসদের।
সকাল পৌনে এগারোটা। ঝিলিমিলি মোড়। বাঁদিকে একটা চালাঘরে তৃণমূলের অস্থায়ী পার্টি অফিস। নানা বয়সের ১৮- ২০ জনের মজলিস। পুলিশ গিয়ে আগেই সেই চালাঘরের সামনে ব্যারিকেড করে দিল (দিদির কাছে নম্বর বাড়াতে কে কী করে বসবেন, ভরসা নেই)। বাসুদেববাবু বুঝলেন কিনা কে জানে! তিনি স্বভাবসিদ্ধ সৌজন্যে হাসিমুখে তাঁদের দিকে তাকিয়েও নমস্কার করলেন। একজন হাত তুলে পাল্টা নমস্কার করতে যাচ্ছিলেন। বড় বড় চোখ করে চেয়ারে বসা এক ‘দাদা’র চাউনি। অমনি হাত নেমে গেল। মুখে কিছুটা ভয়, আর পাল্টা নমস্কার না করতে পারার এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। বাসবাবু মৃদু হেঁসে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে।
ঝিলিমিলি বাজারে ছোট্ট একটা সভা। এমন সময় দুর্গাপুর-বান্দোয়ান একটা বাস ঢুকল। উৎসাহী অনেক চোখ একবার দেখতে চাইল বাসুদেব আচারিয়াকে। ভেতর থেকেই এক কমরেডের মুষ্টিবদ্ধ হাত৷ আড়াল থেকেই জানান দিলেন, কমরেড, সঙ্গে আছি। বাসুবাবু তখন বলেই চলেছেন। সভা শেষে আবার ছোট ছোট মিছিল। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। এক মিছিল থেকে অন্য মিছিলে। আরও একটি আদিবাসী গ্রাম। গিয়ে দেখা গেল, সব পোস্টার ছেঁড়া। আগের রাতে নাকি ছেঁড়া হয়েছে। সেখানেও একপ্রস্থ বক্তৃতা। আমেরিকা থেকে জাতীয় অর্থনীতি, বিজেপি থেকে সারদা— বেশ লম্বা হয়ে গেল৷ সভা শেষে অন্য একটা গ্রামে। এই ফাঁকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, বক্তৃতা একটু দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে না? এতকিছু বলার কী দরকার? মুচকি হাসলেন, ‘ওরা বোঝে না, এমন বার কারণ নেই। মূল্যবৃদ্ধির কথা তো বলতে হবে। তার কারণটাও তো জানা দরকার। কথায় কথা বেড়ে যায়। সব সময় তো হিসেব করে কথা বলা যায় না।’ আরও এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। স্যান্ডো গেঞ্জি পরা ক্লাস ফাইভের এক বাচ্চা। গলায় তিনটে মাদুলি। জিজ্ঞেস করলেন, এই মাদুলিগুলো কে পরালো। কৃতিত্ব নেওয়ার ভঙ্গিতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা উত্তর দিলেন, ‘স্যার আমি পরিয়েছি।’ প্রার্থী মুচকি হাসলেন। একটু দূর গিয়েই বললেন, ‘আমি যখন স্কুলের হেডমাস্টার ছিলাম, তখন সবাইকে মাদুলি খুলতে বলেছিলাম ৷ গার্জেনদের বুঝিয়েছিলাম, এসব পরে কোনও লাভ হয় না। গার্জেনরাও বুঝেছিল, ছেলেরাও বুঝেছিল। আমার ছাত্ররা কিন্তু কেউ মাদুলি পরে না।’ তখন তিনি প্রার্থী নন, যেন এক গর্বিত শিক্ষক।
অনেকগুলি গ্রাম পেরিয়ে আরেকটি গ্রাম। ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটে। সকালের দই চিড়ের পর আর কিছুই জোটেনি। গাছের তলায় তিনি। পাশে কয়েকটি চেয়ার পাতা। ইশারায় বসতে বললেন। হাতে তখন একমুঠো ছোলা ভাজা। কিছুটা যেন কুণ্ঠিত দেখালো, ‘এই রে! আমি একা একা খাচ্ছি! ছোলা খাবেন?’ খাওয়াই যায়। একজনকে বললেন, গাড়ি থেকে ছোলা ভাজার কৌটোটা আনতে। পস্টিকের একটা কৌটো থেকে পরম স্নেহে দিলেন ছোলা ভাজা। বললেন, ‘সারাদিন খালি পেটে থাকতে ডাক্তার বারণ করে। তাই বিস্কুট, ছোলা এগুলো সঙ্গে রাখতে হয়।’ বললাম, আপনি তো এই এলাকার মানুষ। বাঁকড়ি ভাষায় বলেন না কেন? বললেন, ‘বলি তো। বেশ, এখানে তাই বলব।’ বসে বসেই কথা বললেন। নিখাদ বাঁকড়ি আর পুরুলিয়ার ভাষায়। সংসদে ঝড় তোলা বক্তা নন, তখন তিনি যেন গ্রামেরই মানুষ। জনসভা বা পথসভার গাম্ভীর্য নয়, এই গ্রামে যেন বটতলার বৈঠকি আড্ডা। মাঝে মাঝে ফিড ব্যাক নিচ্ছেন, ‘কই, আমি একাই ব’লে যাচ্ছি। তুমরা কিছু রা কাড়ছ নাই য্যা।’ লু বওয়া দুপুরের নৈঃশব্দ ভেদ করে এক গৃহবধূর উত্তর ভেসে এল, ‘আমাদের লিয়ে চিন্তা নাই। আমরা লাল পাটিতেই আছি।’ দ্রুত হাসিটা ছড়িয়ে পড়ল এক মুখ থেকে আরেক মুখে। এমনকি বর্ষীয়াণ প্রার্থীর মুখেও৷
সারাদিনের টুকরো টুকরো কত ছবি! একটা প্রতিবেদন কেন, একটা বই হতে পারে। এতক্ষণ পড়ে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি হতেই পারে। বলতেই পারেন, এক কথা শুনে কী করব? মোদ্দা কথা, তিনি কি জিতবেন? অঙ্কটা কী? বিজেপি কত ভোট কাটবে? এই ধুধু মাঠ, এই সবুজ জঙ্গলের মাঝে থাক না সেই অঙ্কের কথা। কাটাকুটি আর অঙ্কের কথা না হয় স্টুডিওতে বসা বিশ্লেষকেরা ভাবুন। জঙ্গলের মাঝে সেই হিসেব মুলতুবি থাক।