ময়ূখ নস্কর
আমাদের সময়ে বুঝলি, বিশ্বকাপের একটা আলাদা মূল্য ছিল। ক্রিকেট খেলাটারই একটা আলাদা মূল্য ছিল।
কারণ প্রতিটা রান, প্রতিটা উইকেটের আলাদা মূল্য ছিল। তখন দেড়শো রান মানেই লড়াই হবে, ২০০ রান মানে বড় রানের বোঝা চাপানো, আড়াইশো রান মানে, ওরে বাবা!! আর এখন ৪০০ রান করেও নিশ্চিন্ত থাকা যায় না। আমরা আড়াইশো রান করেও ম্যাচ জিততাম আর তোরা ৩৫০ রান করেও টেনশনে দাঁতে নখ কাটিস, তাহলেই ভেবে দেখ কাদের রানের মূল্য বেশি। ১ ডলার=৮৩ টাকা, কোনটা বেশি মূল্যবান?
আমাদের সময়ে বুঝলি, ওপেন করতে নামত সুনীল গাভাস্কার। আহা, সে কি খেলা! কি মূল্যবান সব রান! ষাট ওভার ব্যাট করে নট আউট ৩৬। বোলার মানেই কপিল দেব। তার সঙ্গে আর কারা বল করতো ভুলেই গেছি। অলরাউন্ডার মানে, মহিন্দর অমরনাথ, রাজার বিনি। এই দুজনের নাম মনে আছে কারণ ভারতীয় অলরাউন্ডার একটি বিরল বস্তু ছিল। এখন তো প্রায় সবাই অলরাউন্ডার, আলাদা করে কারোর কোনও গুরুত্ব নেই। আমাদের সময় দু একটা পাগড়ীওয়ালা থাকতো, তাদের বল দেশের মাটিতে বনবন করে ঘুরত আর বিদেশে গেলেই ঠান্ডায় কনকন করে ঘোরা বন্ধ করে দিত। সেই বোলিং নিয়েই বিশ্বকাপ জিতেছিলুম রে বাপু। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে জিতেছিলুম। তোদের মত শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে জিতিনি।
তোদের সময়ে তো ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোয়ালিফাই করতেই পারে না। তোদের সময়ে পাকিস্তান তো দুদুভাতু। আমাদের সময়টা ভেবে দেখ। বল করছে ইমরান, বল করছে লিলি, গার্নার। তাদের সামনে রবি শাস্ত্রী আর গাভাস্কার সারাদিন ঠুকুস ঠুকুস করছে। সেটাই তো আসল ক্রিকেট রে। রান তোলাটা বড় কথা নয়, স্টান্সটাই আসল, স্টাইল টাই আসল। তোদের সময়ে স্টাইল মানে তো বিরাট কোহলি গ্যালারিতে বউকে দেখে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিল। নিজের বউকে ফ্লাইং কিস দিবি তাতে স্টাইলেরর কী আছে রে? আমাদের সময়ে ইয়ান বোথাম, ভিভ রিচার্ডস, ইমরান.. big boys play at night… যাকগে যাকগে খেলার কথায় আসি । সেই আমলের দুর্দান্ত পেস বোলিংয়ের সামনেও কপিল আর শ্রীকান্ত মাঝে মাঝে চার ছয় মারতো। সেই সব মারের আনন্দই আলাদা, এখনকার মতো এক ওভারে ৭২ রান উঠত না। আমরা হাততালি দিতাম আর ভাবতাম শটটা ক্রিকেটীয় না অক্রিকেটীয়?
একবার এক কান্ড হয়েছিল। ১৯৮৭ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গাভাস্কার সাতাশি বলে সেঞ্চুরি করল। আমরা তো বিস্ময়ে চোখ কচলে কচলে চোখ দুটোকে সিপিএমের পতাকা করে ফেললাম। ওয়ান ডেতে গাভাস্কারের সেঞ্চুরি! তাও আবার সাতাশি বলে! সেই ম্যাচেই চেতন শর্মা হ্যাটট্রিক করে ফেলল। করে চেতনের প্রাণ বিস্ময়ে এমন জেগে উঠলো যে সে পিচের উপরেই প্রায় ভিরমি খায় আর কি!
আসল সমস্যা হল ম্যান অফ দা ম্যাচ পুরস্কার ঘোষণা করার সময়। গাভাস্কারের জীবনের একমাত্র ওয়ানডে সেঞ্চুরি, ওদিকে একজন ভারতীয় বোলারের হ্যাটট্রিক, কোন কূল রাখবে ঠিক করতে না পেরে নির্বাচকরা মেন অফ দা ম্যাচ ঘোষণা করে দিল। অর্থাৎ, দুজনকেই দিয়ে দিল। অমন কাণ্ড জীবনে আর কোনও ম্যাচে দেখিনি।
আমাদের সময়ে সেই ক্রিকেট ছিল পাড়ার রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যা। ধূপের ধোঁয়া, রজনীগন্ধার মালা, হারমোনিয়ামের প্যাঁ পোঁ। আর তোদের ক্রিকেট যেন বারোয়ারি গণেশ পূজার মিউজিক্যাল ধামাকা। ঝ্যাম্পার ঝ্যাম্পা বাদ্যি বাজছে, মাইকে স্লোগান দিচ্ছে, টর্চের মতো এদিকে ওদিকে আলো ফেলছে, কেউ চার ছয় মারলেই উড়ন তুবড়ির মতো বাজি ফুটছে। ছ্যা ছ্যা, চার ছয়ের কৌলিন্য বলে কিছু রইল না! ভারতে বিশ্বকাপ হচ্ছে, উইকেট পাচ্ছে পেসাররা আর স্পিনাররা গ্যালারিতে spinsterদের দিকে তাকিয়ে সময় কাটাচ্ছে। বিষণ সিং বেদী মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছেন। শুধু মাঝে মাঝে যখন হঠাৎ আলো নিভে যায়, মনে একটু শান্তি পাই। মনে হয়, আশির দশকের লোডশেডিং আবার ফিরে এল।
তবে হ্যাঁ একটা জিনিস ভালো হয়েছে, আজকাল ভারতের ম্যাচে টেনশন টেনশন বলে কিছু নেই। আগে ব্যাট করলেও জিতব, পরে ব্যাট করলেও জিতব। ব্যাটসম্যানরা না জেতালে বোলাররা জেতাবে। আমাদের সময় জিম্বাবোয়ে অব্দি চমকে দিত। পেস ব্যাটারির সামনে ব্যাটাররা বাটারের মতো গলে যেত। এই বয়সে, এই শরীরে সেই টেনশন সহ্য হত না।
তোদের এইসব খেলায় টেনশনের কিছু নেই। তোরা আনন্দ করছিস কর, আমি প্রেসারের ওষুধ খেতে যাই। একটাই অনুরোধ, দয়া করে আমার বাড়ির সামনে চকলেট বোমা ফাটাস না।