রান জানতে চেয়ে লজ্জা দেবেন না

স্বরূপ গোস্বামী

আমরা নাকি ফিনিক্স পাখির মতো। বারবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসি। এবারের বিশ্বকাপের কথাই ধরুন। প্রথম দুটো ম্যাচেই হেরে গেলাম। দুটো ম্যাচে হারা কী এমন ব্যাপার। অনেকেই হারে। কিন্তু আমরা পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বলে কথা। পান থেকে চুন খসলেই গেল গেল রব উঠে যায়। এই অস্ট্রেলিয়া আগের অস্ট্রেলিয়া নয়, এমন প্রচার তো লেগেই আছে। টানা দুই হারে সেটা আরও জোরালো হয়। কিন্তু সেখান থেকে আমাদের জয়ের ঘোড়া ছুটতে শুরু করল। একের পর এক কঠিন বাধাও পেরিয়ে গেলাম।

তাই বলে শেষবেলায় এসে কিনা আফগানিস্তানের কাছে হারতে হবে‌‌!‌ দেশের মিডিয়া, প্রাক্তনরা ছিড়ে খেত। বলা হত, এরা অস্ট্রেলিয়া নামের কলঙ্ক। এরা আফগানিস্তানের সঙ্গেও জিততে পারে না!‌ এদের হলুদ জার্সি গায়ে খেলার যোগ্যতাই নেই। ধুপধাপ করে এত দ্রুত সাত উইকেট পড়ে যাবে, কে ভেবেছিল!‌ আমাদের ব্যাটিংয়ে কী সব ভয়ঙ্কর নাম!‌ ডেভিড ওয়ার্নার, মার্নাস লাবুশেন, স্টিভ স্মিথ, মিচেল মার্শ। কেউ দাঁড়াতে পারল না!‌ একে একে সবাই ফিরে গেল!‌ জেতা তো দূরের কথা, একশো রানও উঠবে কিনা সন্দেহ। এই আশঙ্কাই তখন তাড়া করছে। আমি দলের অধিনায়ক। ধারে ভারে অ্যালান বর্ডার, স্টিভ ওয়া বা রিকি পন্টিংয়ের একশো মাইলের মধ্যেও আসি না। তবু অধিনায়ক তো!‌

আমি আবার তেমন ব্যাট করতে পারি না। বোলার হিসেবেই লোকে একটু আধটু চেনে–‌টেনে। সেখানেও লিলি–‌টমসন তো ছেড়ে দিন, অতীতের ম্যাকগ্রাথ, ব্রেট লিদের ধারেকাছেও আসি না। এমনকী এখনকার দলেও যে স্টার্ক, হ্যাজেলউডরা আছে, ধারেভারে তারাও আমার থেকে এগিয়ে। প্যাট কামিন্স কে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনে রাখতে বয়েই গেছে। অস্ট্রেলিয়ার সেরা একশো ক্রিকেটারের তালিকাতেও হয়ত আমার নামটা থাকবে না। এই সহজ সত্যিটা আমার থেকে ভাল আর কে বোঝে!‌

তখনও বাকি প্রায় আড়াইশো রান। উল্টোদিকে ম্যাক্সওয়েল। ও না হয় ভাল ব্যাট করে, তাই বলে এতটা টানতে পারবে?‌ সত্যিই বলছি, বিশ্বাস হয়নি। আমি নিজেই বা কতক্ষণ টানতে পারব!‌ যে কোনও সময় হুট করে হয়ত আউট হয়ে যাব। বাকি দুজন আসবে আর যাবে।

সত্যিই বলছি, ওই জায়গা থেকে জয়ের স্বপ্ন দেখা সম্ভব ছিল না। অতিবড় আশাবাদী হয়েও সম্ভব ছিল না। কিন্তু উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যাক্সি ভেবেছিল। প্রথমে আমরা একশোর গন্ডি পেরোলাম। তারপর দেড়শো। তখন ভাবছি, যাক কিছুটা মানরক্ষা হয়তো হবে। টেনেটুনে দুশো পর্যন্ত নিশ্চয় পৌঁছে যাব। তাহলেও লজ্জা কিছুটা কমবে। বলা যাবে, আমরা অন্তত লড়াই করেছি। গো হারান হারিনি। ম্যাক্সি কিন্তু তখনও বলে চলেছে, ‘‌ক্যাপ্টেন, তোমাকে রান করতে হবে না। তুমি শুধু একটা দিক ধরে রাখো, বাকিটা আমি সামলে দিচ্ছি।’‌ যেন আমি চাইলেই বিশাল রান করতে পারি!‌ আরে বাবা, ব্যাটের হাত যদি এতই ভাল হত, তাহলে কি ৯ নম্বরে ব্যাট করতে নামি!‌ আমার কাজ কয়েক ওভার ঠেকা দেওয়া। যদি পনেরো–‌কুড়ি রান এসে যায়, মন্দ কী‌!‌

বিশ্বাস করুন, ফিল্ডারদের মাঝে কোথায় গ্যাপ আছে, কোনদিকে রান আসতে পারে, এসব ভাবার চেষ্টাও করিনি। আমি শুধু জানতাম, যেভাবে হোক, উইকেট আঁকড়ে থাকতে হবে। রান যা করার, ম্যাক্সি করবে। ওর জাস্ট একজন ঠেকা দেওয়া সঙ্গী দরকার। আমি হলাম সেই সঙ্গী। এর বেশি কিছু নয়। একসময় ছেলেটা একশো পেরিয়ে গেল। মনে হল, যাক, ছেলেটা সেঞ্চুরি তো পেল। অনেকটাই লড়াই করা গেছে। এটুকু ওর প্রাপ্য ছিল। ও তখনও এসে বলে গেল, ‘‌টিকে থাকলে রান হয়ে যাবে, তুমি চিন্তা কোরো না।’‌ সত্যিই আমি চিন্তা করিনি। কারণ, জয় তখন আলোকবর্ষ দূরে। ওখানে দাঁড়িয়ে জয়ের কথা ভাবব!‌ আমি কি এতখানি পাগল নাকি!‌ ম্যাক্সি ক্ষেপেছে বলে কি আমাকেও ক্ষেপতে হবে নাকি!‌

ওদিকে, ম্যাক্সির পায়ে টান ধরেছে। বেচারা ছুটতে পারছে না। এদিকে, রানার নেওয়াও যাবে না। আইসিসি নাকি নতুন নিয়ম করেছে। একটা ছেলে ছুটতে পারছে না, ঠিকমতো দাঁড়িয়েও থাকতে পারছে না, সে রানার নিতে পারবে না‌!‌ কারা এই নিয়ম বানাল?‌

বেচারার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেমন চার–‌ছয় মেরে চলেছে। কখনও কষ্ট হচ্ছে। আবার কখনও গর্বও হচ্ছে। ছেলেটা তো মিরাক্যাল ঘটাচ্ছে!‌ আমিও তখন একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে। দেখতে দেখতে আমরা জয়ের কাছাকাছি চলে এসেছি। আমিও বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, হ্যাঁ, এবার সম্ভব। ছেলেটা স্বপ্ন দেখতে জানে, দেখাতেও জানে। পাহাড়প্রমাণ চাপ মাথায় নিয়ে, সেই স্বপ্নকে সত্যি করে দেখাতেও জানে।

এদিকে জয়ের জন্য দরকার পাঁচ রান। ওদিকে, পাঁচ রান হলে ছেলেটার ডাবল সেঞ্চুরি হয়ে যাবে। বিশাল ছক্কায় দুটোই একসঙ্গে হয়ে গেল। ওই অবস্থা থেকে ম্যাচ জেতা!‌ এ তো রূপকথার মতো। চোট নিয়েও এমন ডাবল সেঞ্চুরি। ইনিংসটা তো বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে ঢুকে পড়ল। এমন একটা ইনিংস আমি উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে দেখলাম। এমন একটা রূপকথার আমিও কিনা শরিক হলাম!‌

উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা আমার রান কত!‌ রান জিজ্ঞেস করে লজ্জা দেবেন না।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.