সজল মুখার্জি
আমাদের ছোটবেলায় কেউ কোনও বিষয়ে লেটার পেয়েছে শুনলে আমরা তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বাড়ির লোকেরা, স্যারেরা বলতেন, দেখ, এই ছেলেটি অঙ্কে লেটার পেয়েছে। আমাদেরও মনে হত, এই ছেলেটি আমাদের পাড়ায় থাকে! এটা তো আমাদের কাছে গর্বের বিষয়। আমরাও অন্যদের দেখাতাম, দেখ, ওই দাদাটা অঙ্কে লেটার পেয়েছে।
কিন্তু এখন সময় বদলেছে। এখন মুড়ি–মুড়কির মতো লেটার। কেউ আর অবাক হয়ে তাকায় না। বরং, ৯৫ পেলেও দেখেছি বাবা–মায়ের মুখ ভার। কেন তাঁদের ছেলে একশোয় একশো পেল না! হ্যাঁ, এখন ভুরি ভুরি নম্বর উঠছে। যে কেউ আশি–পঁচাশি পেয়ে যাচ্ছে। আপাতভাবে মনে হতেই পারে, ছেলেটি বোধ হয় দারুণ মেধাবী। কিন্তু একটু কথা বললেই বোঝা যাচ্ছে, যে বিষয়ে লেটার পেল, সেই বিষয়ের একেবারে সাধারণ জিনিসগুলোও জানে না। বাংলায় লেটার, অথচ পথের পাঁচালি কার লেখা, জানে না। আরণ্যক বা কপালকুণ্ডলা বা গোরা কার লেখা, জানে না। অঙ্কে লেটার, অথচ একেবারে সেভেন–এইটের প্রাথমিক বিষয়গুলোই জানে না। ৪৫ ডিগ্রি কোন কীভাবে আঁকতে হয়, সেটুকুও জানে না। ইতিহাস, ভূগোল, বায়োলজি, ফিজিক্স সব ব্যাপারেই এই ছবি।
প্রশ্ন জাগে, এই ছেলে কীভাবে এত নম্বর পেল? কারাই বা দিলেন? কী দেখেই বা দিলেন? যে সত্যিই আশি পাওয়ার যোগ্য, সেও যা পাচ্ছে, যার কুড়ি পাওয়ার মতোও যোগ্যতা নেই, সেও প্রায় তাই পাচ্ছে। আদৌ খাতা দেখা হচ্ছে তো! যতই প্রশ্ন জানা থাক, যতই দরাজ হস্তে নম্বর দেওয়া হোক, তবু কোনওভাবেই এইসব খাতায় তিরিশের বেশি নম্বর ওঠার কথা নয়। তাহলে আশি–নব্বই উঠছে কীভাবে?
আমার মনে হয়, এই বিষয়েও একটা তদন্ত হওয়া জরুরি। জোর করে নম্বর বাড়িয়ে সেটাকে শিক্ষার সাফল্য বলে চালানো হচ্ছে। আসলে, ছেলেগুলোর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। বাবা–মা বুঝতেও পারছেন না, ছেলে আসলে কত পেল। মায়ের উচ্চাকাঙ্খাপূরণের জন্য ছেলেকে সায়েন্স নিয়ে পড়তেও হচ্ছে। অথচ, ওটা কোনওভাবেই তার বিষয়ই নয়।
শিক্ষক দিবসে এই বিষযটা নিয়ে আত্মসমীক্ষা হওয়া খুব জরুরি। বেশি নম্বর পেয়ে এখন ওরা হয়ত হাওয়ায় ভাসছে। কিন্তু সেই ভাসা গ্যাস বেলুনের মতোই। যেদিন গ্যাস ফুরিয়ে যাবে, সেদিনই মাটিতে নেমে আসতে হবে। তাই ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি না খেলাই ভাল। বেশি নম্বর ওদের আরও বিপথগামী করে তুলছে।