উত্তম কুমারের মৃত্যুদিন বহুচর্চিত। কিন্তু জন্মদিন কেন সাদা কালো? উত্তমের নায়িকা বলতে সুচিত্রা বা সুপ্রিয়ার নাম ভেসে ওঠে। সাবিত্রীর মুখ কেন ভেসে ওঠে না? হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যদি পূব আকাশের উত্তমের গায়ক হন, যদি মাঝ আকাশে শ্যামল মিত্র–মান্না দে থাকেন, তাহলে শেষযাত্রার উত্তম কেন কিশোর কুমারে ভরপুর হবে না? তিন প্রশ্ন উস্কে দিলেন কুণাল দাশগুপ্ত।
কত ক্যালেন্ডার আসে যায়। ফি বছর নিয়ম করে। ৩ সেপ্টেম্বর সেঁটে থাকে শুধুমাত্র একটা সংখ্যা হয়ে। টালিগঞ্জে মহানায়কের মূর্তিতে মালা পরিয়ে নমো নমো করে লক্ষ্মীপুজো হয় মাত্র। উত্তম কুমারের জন্মদিনে রঙ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বরং, মৃত্যুদিনেই বর্ণময় উত্তম। উত্তম মানেই লোকে বোঝে জুলাই মাস। শেষ সপ্তাহে টিভি থেকে এফএম, ফেসবুক থেকে পাড়ার গুলতানিতে বয়ে উত্তম–ঝড়। কোনওদিন হলে গিয়ে উত্তমের কোনও ছবি না দেখা বাঙালিও হয়ে যান উত্তম বিশারদ। অথচ, সেপ্টেম্বরের শুরুতে এসব কিছুই চোখে পড়ে না।
অনেক অজানা রহস্যের মতো মহানায়ককে ঘিরে তিনটে রহস্যের কিনারা আজও পাওয়া যায়নি। ১) উত্তম কুমারের জন্মদিন কেন সাদা কালো? ২) বিপরীতে অভিনয় করার জন্য সুচিত্রা বা সুপ্রিয়ার বদলে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে আরও বেশি করে সামনে রাখা হল না কেন? ৩) হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যদি পূব আকাশের উত্তমের গায়ক হন, যদি মাঝ আকাশে শ্যামল মিত্র–মান্না দে থাকেন, তাহলে শেষযাত্রার উত্তম কেন কিশোর কুমারে ভরপুর হবে না?
কিংবদন্তিকে স্মরণ করার জন্য সাধারণত জন্মদিনকেই বেছে নেওয়া হয়। রবি ঠাকুর থেকে কিশোর কুমার। পঁচিশে বৈশাখ কিংবা ৪ আগস্ট। যত ধুমধাম ওই জন্মদিন ঘিরেই। কিন্তু মহানায়কের নিষ্প্রভ জন্মদিন সব হিসেবপত্তরকে ওলট–পালট করে দেয়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সারা বছর কত উৎসবে অথবা বে–উৎসবে কত গান বাজে। কিন্তু ৩ সেপ্টেম্বর নিশ্চুপ কেন? কেন নিস্তব্ধতা? ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস, আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা, বড় একা লাগে বা কী আশায় বাঁধি খেলাঘর কেন হঠাৎ করে ওই দিনটাতেই হারিয়ে যায়! উত্তর মেলে না।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গ। উত্তম মানে শুধু সুচিত্রা বা সুপ্রিয়ার ছবি নয়। নয় ওই দুই নায়িকার হৃদয়ের অন্তর্দ্বন্দ্ব। সেখানে জাঁকিয়ে রাজ করে গেছেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। নয় নয় করে ৩৯ টি হিট ছবিতে। মৌচাক, গৃহদাহ, মরুতীর্থ হিংলাজ, ধন্যি মেয়ে, এমন কত সেলুলয়েড গানের স্পন্দন পেয়েছে। প্রেমেরও। ‘অভিনয় নয়’ হয়ে উঠেছে অসংখ্যবার। তবু সাবিত্রীকে তৃতীয় প্রধান হয়েই কাটিয়ে দিতে হল। দোষ কার? দর্শক না চিত্র সমালোচকদের? কে জানে?
ঠিক তেমনভাবেই, অবহেলিত কিশোর কুমারও। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে উত্তমের গলার অদ্ভুত মিল ছিল। কিন্তু সেটা নেহাত কাকতালীয়। কারণ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দেবানন্দ বা বিশ্বজিতের গলার সঙ্গে খুব একটা মিলমিশ খায়নি হেমন্ত–কণ্ঠ। তবু গোড়ার দিকে বহু কালজয়ী গান রচিত হয়েছে এই দুজনকে ঘিরে। একটা সময় সেই জায়গায় এসেছেন শ্যামল মিত্র। দুই গলার মধ্যে বিস্তর তফাত। হেমন্ত কণ্ঠ আর শ্যামল কণ্ঠের মধ্যে পার্থক্যটা আসমান–জমিন। তাহলে মাঝে থাকা উত্তমের সঙ্গে শ্যামল কণ্ঠ মেলে কী করে? শ্যামল মিত্রর মায়াবী গলা শ্রোতা–দর্শককে এই বাছবিচার করার সুযোগ দেয়নি। যেমন দেয়নি মান্না দের গান। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, স্ত্রী বা সন্ন্যাসী রাজার মেজাজ মান্না দে ছাড়া ভূভারতে আর কার কাছেই বা পাওয়া যাবে?
শেষ লগ্নে কিন্তু উত্তম কুমারকে অক্সিজেন জুগিয়েছিলেন কিশোর কুমার। হ্যাঁ, সাতের দশকের শুরুর সবরমতী বা রাজকুমারী নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু অমানুষ, আনন্দ আশ্রম, বন্দি এমনকী ওগো বধূ সুন্দরী ছবিতে যে প্লে ব্যাক কিশোর কুমার করেছিলেন, তা নেপথ্য গায়কদের বর্ণ পরিচয় হিসেবে বেঁচে থাকবে। গানের ফাঁকে কিশোর কুমার যখন সংলাপ বলেছেন, মনে হয়েছে সে সংলাপ যেন উত্তমই বলছেন। এমনটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। কিন্তু কিশোর কুমার এই কাণ্ডটি সব নায়কের ক্ষেত্রেই নিখুঁতভাবে ঘটিয়েছেন। তবু সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতোই কিশোর কুমারেরও জুটেছে একরাশ উপেক্ষা। ফল যেটা হয়েছে, তা হল, উত্তম কুমারের মূল্যায়নে বিস্তর বিচ্যূতি থেকে গেছে।
হয়ত এর উত্তর পাওয়া যাবে একদিন। হয়ত যাবে না। হয়ত সপ্তর্ষিমণ্ডলের মতো ছায়াছবির আকাশে প্রশ্নচিহ্ন হয়েই বিরাজ করে যাবে অনন্তকাল।
মহানায়ক উত্তম কুমারকে নিয়ে বেঙ্গল টাইমসের বিশেষ সংখ্যা— এখনও উত্তম।
পুরো বইটি পড়ুন। ভাল লাগলে অন্যদের শেয়ার করতে পারেন।
(পিডিএফ ফাইলটি আপলোড করা হল। নীচের ওয়েব লিঙ্কে ক্লিক করলেই খুলে যাবে। প্রচ্ছদের ছবিতে ক্লিক করলেও ম্যাগাজিনটি খুলে যাবে। সেখান থেকেও পড়তে পারেন।)
https://bengaltimes.in/wp-content/uploads/2023/07/UTTAM-KUMAR-ISSUE.pdf