মানস সেনগুপ্ত
পচাত্তরে আমার জন্ম হয়নি। উনআশিতে জন্মেছি ঠিকই, কিন্তু বয়স মাত্র দু’বছর। এই দুবারই বিশ্বকাপ জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। চারবছর পর ফের এল বিশ্বকাপ। তখন আমার বয়স ছয় বছর। তখন মোবাইল তো দূরের কথা, মফস্বলে টিভিও আসেনি। তখনও ক্রিকেট রান্না ঘরে পৌঁছে যায়নি। মাঠে কেউ কেউ খেলত
ঠিকই, যতদূর মনে পড়ে, তখন বলা হল ব্যাট–বল খেলা।
তখন নাকি ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। বিশ্বাস করুন, বিশ্বকাপ কী জিনিস, তখন সত্যিই বুঝিনি। এমনকী ক্রিকেট আর ব্যাট–বল যে আসলে একই খেলা, তাও বুঝিনি। তাই ভারতের বিশ্বকাপ জয় নিয়ে আমার মোটেই আলাদা কোনও অনুভূতি নেই। ভারত যে বিশ্বকাপ জিতেছে, এটা বুঝতে শিখেছি ছিয়াশি–সাতাশি নাগাদ। এরপর এল সাতাশির বিশ্বকাপ। ঠিক তার কয়েক মাস আগেই বাড়িতে টিভি এসেছিল। তখন ফুটবল বিশ্বকাপ বা ক্রিকেট বিশ্বকাপের আগে অনেকের বাড়িতেই নতুন টিভি আসত। আমাদের টিভির মডেলটা এখনও মনে আছে, ওয়েস্টার্ন ক্যাপ্টেন। সাদা কালো টিভি। দুপাশে সাটার দেওয়া। টিভি বন্ধ করলে সেই সাটারও বন্ধ করে দেওয়া হত। ওই সাটারে আবার চাবিও ছিল। অর্থাৎ, বাড়ির ছোটরা যেন যখন তখন টিভি চালাতে না পারে, তাই চাবি দিয়ে রাখা হত।
ততদিনে হাতে এসে গেছে খেলা পত্রিকা, খেলার আসর। কাগজের দোকানি বিল্লু জেঠু মাঝে মাঝে স্পোর্টসস্টারও আনতেন। তখন স্পোর্টসস্টার বা স্পোর্টসওয়ার্ল্ড কী, তা বোঝার বয়স হয়নি। সেখানে মাঝের পাতায় দু পাতা জুড়ে ইয়াব্বড় পোস্টার ছিল। তাই হয়ত স্পোর্টসস্টার না বলে বলতাম ‘পোস্টার’। একে ভারত গতবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তার ওপর সাতাশির বিশ্বকাপ হচ্ছে ভারত–পাকিস্তানের মাটিতেই। স্বভাবতই, সেবার উন্মাদনা ছিল তুঙ্গে। খেলার পত্রপত্রিকাতে ঘুরে ফিরে সেই তিরাশি সংক্রান্ত বিভিন্ন লেখা। কোনওটায় আবার তিরাশির সব ম্যাচের স্কোর, ম্যাচরিপোর্ট। সাতাশিতে বসেই টাইম মেশিনে যেন চলে গিয়েছিলাম সেই তিরাশির বিশ্বকাপে। কিশোর চোখ তখন লর্ডসের ব্যালকনিতে কপিলদেবের হাতে বিশ্বকাপ দেখছে। শ্যাম্পেন কী জিনিস, বুঝতাম না। কিন্তু থামসআপের বোতলে আঙুল চেপে রেখে ঝাঁকিয়ে দিতাম। তারপর একটা দিক একটু ফাঁক করতাম। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসত ফেনা। ওই আমাদের শ্যাম্পেন ছড়ানো।
সাতাশির একটার পর একটা ম্যাচ দেখছি। আর টিভিতে তিরাশির ক্লিপিংসও দেখছি। সাতাশি আর তিরাশি যেন মিলেমিশে একাকার। সেই সাতাশিতে এসেই তিরাশির হাতেখড়ি। সাতাশির সেমিফাইনালে আমরা ইংল্যান্ডের কাছে হেরে গিয়েছিলাম। কিন্তু মনে পড়ে গেল, তিরাশির সেমিফাইনালে কিন্তু আমরা এই ইংল্যান্ডকেই হারিয়েছিলাম। ভারতের একটার পর একটা উইকেট পড়ছে। বারবার মনে হচ্ছিল, জিম্বাবোয়ের সেই ম্যাচের পর কেউ কেন কপিলদেব হয়ে উঠতে পারছেন না!
সেবার ফাইনাল হয়েছিল ইডেনে। অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ড। ওই ম্যাচ দেখার বিরাট কোনও আগ্রহ ছিল না। কিন্তু ওই ম্যাচের ফাঁকে ফাঁকে তিরাশির ফাইনালের ক্লিপিংস যদি দেখায়! সেই আশাতেই বসেছিলাম ফাইনাল দেখতে। মাঝে মাঝেই দেখিয়েছিল লর্ডসের ব্যালকনিতে কপিলদের সেই উল্লাস। টাইম মেশিনে চার বছর পিছিয়ে যেতে সেদিন অদ্ভুত একটা আনন্দ হয়েছিল।