একাকী দাঁড়িয়ে জয় গোস্বামী, কেউ চিনতেও পারছেন না। পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছেন ঋতুপর্ণা। তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার কী হুড়োহুড়ি! এ কোন বইমেলা? লিখলেন রাহুল বিশ্বাস।।
বইমেলা মানেই বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। সবটা যে খুব আনন্দ দিয়ে যায়, এমন নয়। এমন কিছু ঘটনা নজরে পড়ে যায়, যা হয়ত কাঙ্খিত ছিল না। বছর চারেক আগের একটি স্মৃতি তুলে ধরছি। অফিস ছুটির পর গেছি করুণাময়ীতে। তেমন ভিড় ছিল না। বইমেলা মানেই বিভিন্ন সাহিত্যিকের দেখা মিলবে, এ আর নতুন কথা কী? যখন থেকে বইমেলা আসছি, কত সাহিত্যিককে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাঁদের ঘিরে কত ভিড়, কত সই শিকারির আবদার। কত ছবি তোলার আবদার। সেদিন একটু অন্যরকম ছবি। একটু দূরে একাকী দাঁড়িয়ে ছিলেন কবি জয় গোস্বামী।
যাঁরা হেঁটে যাচ্ছিলেন, অনেকেই তাঁকে চিনতেও পারলেন না। ভাবতে বেশ অবাকই লাগল। বইমেলায় এসেছে, অথচ জয় গোস্বামীকে চেনে না! এরা কারা? এরা বইমেলায় আসে কেন? আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে। দূর থেকে দেখে যাচ্ছি। টানা দশ–পনেরো মিনিট কাটল। একজনকেও দেখলাম না কবির সঙ্গে এগিয়ে এসে কথা বলছেন। একবার মনে হল যাই। গিয়ে নমস্কার করে আসি। পরে মনে হল, গিয়ে কীই বা বলব! বলব, আপনার কবিতা পড়েছি? এমন বোকা বোকা কথা শুনলে তিনি হয়ত বিরক্তই হবেন। কারণ, এমন কতা কয়েক লক্ষ বার শুনেছেন। তাছাড়া সত্যিই তো, কতটুকুই বা পড়েছি? তাঁর কটা বই কিনেছি? কটা কবিতা মুখস্থ বলতে পারি? আবৃত্তির সুবাদে বিখ্যাত হয়ে ওঠা কয়েকটা কবিতার কথা হয়ত জানি। সেগুলো দাঁত কেলিয়ে বলতে যাওয়া মানে কবিকে বুঝিয়ে দেওয়া, যেটুকু শুনেছি আবৃত্তির দৌলতে। বই কিনে নয়।
এসব মনে মনে ভাবছি, হঠাৎ দেখলাম একটা ভিড় কবির পাশ দিয়ে চলে গেল। অন্তত পঞ্চাশ জনের ভিড়। কী ব্যাপার? কাকে ঘিরে এই ভিড়। দেখলাম গটগট করে হেঁটে চলেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। তাঁকে ঘিরে ছজন বাউন্সার। আর যা হয়! পেছন পেছন বিরাট একটা ভিড়। ঋতুপর্ণা কোন স্টলে যাচ্ছিলেন, কোন অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন, জানি না। কিন্তু তাঁকে ঘিরে এই আদেখলাপনা দেখে কিছুটা খারাপই লাগল। যাঁরা ঋতুপর্ণার পেছনে পেছন একটু ছবি তোলার জন্য ছুটে গেলেন, তাঁরা কেউ পাশে দাঁড়ানো জয় গোস্বামীর দিকে তাকিয়েও দেখলেন না। এমনকী স্বয়ং ঋতুপর্ণাও জয় গোস্বামীকে চিনতে পারলেন না। পারলেও এক সেকেন্ড দাঁড়ানোর সৌজন্য দেখালেন না।
এ কোন বইমেলা, যেখানে ঋতুপর্ণার পেছনে এমন ভিড়, অথচ জয় গোস্বামীকে একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়! কেউ ফিরেও তাকায় না। কবি নিজেও তাকিয়ে রইলেন ভিড়ের দিকে। ভিড় চলে গেল। তিনি রাস্তার ধারে একাকী দাঁড়িয়েই রইলেন। কী ভাবছিলেন, মনে মনে কোনও কবিতা জন্ম নিচ্ছিল কিনা জানি না। হ্যাঁ, এই হুড়োহুড়ি, এই আদেখলাপনা—এটাই হয়ত মূলস্রোত বইমেলা। নির্বাক মুখ নিয়ে একাকী কবির দাঁড়িয়ে থাকা, এটাও বইমেলা।