সরোজ চক্রবর্তী
দেখতে দেখতে দুটো বছর পেরিয়ে গেল। দিয়েগো মারাদোনা যে আর এই পৃথিবীতে নেই, সেটা এখনও বিশ্বাসই হয় না। বিশ্বকাপ মানেই তাঁর অনিবার্য উপস্থিতি। কখনও রূপকথার ফুটবল খেলে নতুন ইতিহাস তৈরি করছেন। কখনও নির্বাসিত, কলঙ্কিত। কখনও একেবারে শিশুর মতো, গ্যালারিতে দেশের পতাকা উড়িয়ে চিৎকার করছেন। আবার কখনও কোচের ভূমিকায়।
সেই মারাদোনা বেঁচে থাকলে কী করতেন? নিশ্চিতভাবেই পৌঁছে যেতেন কাতারের গ্যালারিতে। ভিআইপি বক্সে নয়। একেবারে জনতার মাঝে থেকেই হাত নাড়াতেন। পতাকা ওড়াতেন। আর মেসিদের উজ্জীবিত করে যেতেন। একদিকে সেই মানুষটার মৃত্যুদিন, অন্যদিকে আর্জেন্টিনা দাঁড়িয়ে অদ্ভুত এক সন্ধিক্ষণে। যারা বিশ্বকাপের অন্যতম দাবিদার, তারা কিনা প্রথম ম্যাচেই হেরে বসল! তাও আবার তুলনায় অখ্যাত সৌদি আরবের কাছে? খোদ সৌদি আরবের কোচ বা ফুটবলাররাও কি ভাবতে পেরেছিলেন তাঁরা মেসিদের হারিয়ে বিজয়োল্লাস করবেন! কিন্তু পথের বাঁকে কার জন্য কোন চিত্রনাট্য লেখা থাকে, কে বলতে পারে!
ছোট দল আর বড় দলের ফারাক এখন অনেকটাই কমে এসেছে। এখানে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দেয় সৌদি আরব। জার্মানিকে হারিয়ে দেয় জাপান। এশিয়ার দুই শক্তির এই উত্থানে ভাল লাগারই কথা। কিন্তু বাঙালি যে অনেক আগেই মন দিয়ে বসে আছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানিকে। চেতনায়, মননে সে যে যথার্থই আন্তর্জাতিক। তাই এশীয় শক্তির জয়ে মনের একটা কোণে যখন উল্লাস, অন্য একটা মনে যেন বিষণ্ণতা। সৌদি, জাপান জিতছে, ঠিক আছে। তাই বলে আর্জেন্টিনা–জার্মানির হারটাও কি মেনে নেওয়া যায়!
অদ্ভুত এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে লিওনেল মেসি। এটাই তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। প্রত্যাশার সীমাহীন চাপ তো থাকবেই। হয়ত পুরোপুরি স্বপ্নপূরণ হল না। কিন্তু একটা দুরন্ত লড়াই তো থাকবে। ফাইনাল না হোক, নিদেনপক্ষে শেষ চার। কিন্তু পরিস্থিতি এমনই, শনিবার মেক্সিকোর কাছে হারলেই বেজে যাবে বিদায়ঘণ্টা। প্রথম ম্যাচ যদি জিতে থাকতেন, তাহলে মেক্সিকো নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হত না। এই চাপের আবহও তৈরি হত না। কিন্তু প্রথম ম্যাচে হেরে যাওয়ার চাপটা সাঙ্ঘাতিক। ঘরে–বাইরে উঠবে সমালোচনার ঝড়। আগে খেলোয়াড়রা বলতেন, খেলার সময় টিভি দেখো না, কাগজ পোড়ো না। কিন্তু বদলে যাওয়া এই পৃথিবীতে নানা বার্তা তো মোবাইল বেয়ে হাতের মুঠোয় চলে আসছে। কতক্ষণই বা মুখ লুকিয়ে থাকবেন। কেউ উজ্জীবিত করছেন, কেউ সতর্ক করছেন, কেউ জ্ঞান দিচ্ছেন, কেউ নির্মম সমালোচনা করছেন। একেক প্রতিক্রিয়ার একেক অভিঘাত। আপনি চান বা না চান, ছুঁয়ে যাবেই।
উঠে আসছে নব্বইয়ের ক্যামেরুন ম্যাচের কথা। ছিয়াশির বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনা নব্বইয়ের উদ্বোধনী ম্যাচেই হেরে গিয়েছিল ক্যামেরুনের কাছে। সেবারও গেল গেল রব উঠেছিল। কিন্তু সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল ঘুরে দাঁড়ানো। একের পর এক শক্ত বাধা পেরিয়ে, এমনকী ব্রাজিল, ইতালির মতো দেশকে হারিয়ে আর্জেন্টিনা পৌঁছে গিয়েছিল ফাইনালে। সেখানেও শেষমুহূর্ত পর্যন্ত ছিল তুল্যমূল্য লড়াই। একেবারে শেষবেলার বিতর্কিত পেনাল্টিতে হারতে হয়েছিল। সেবার যদি মারাদোনারা ফিরে আসতে পারেন, এবার মেসিরা পারবেন না? সামনে কারা? মেক্সিকো। এই নামটা শুনলেই প্রথমে কোন ঘটনা মনে পড়ে? ছিয়াশির সেই বিশ্বজয় তো এসেছিল মেক্সিকোর মাটিতেই। সেদিনের আয়োজক, আজকের প্রতিপক্ষ। কিন্তু মেক্সিকো নামটার মধ্যেই যে রয়ে গেছে ইতিহাসের হাতছানি। যে ইতিহাস লিখে গিয়েছিলেন মারাদোনা।
অর্থাৎ, মৃত্যুর দু’বছর ঘুরে দাঁড়াতে তুলে আনা হচ্ছে তাঁরই উদাহরণ। এখনও তিনি জীবন্ত। এখনও সেই তিনিই প্রেরণা। কে বলল, কাতারের গ্যালারিতে তিনি নেই! সেই কবে রবি ঠাকুর লিখে গেছেন, রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।