সোহম সেন
সুনীল গাভাসকারকে দেখে এগিয়ে আসছেন বাবর আজম। বুঝে নিতে চাইছেন তাঁর ব্যাটিংয়ে সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে। সানির মনেও কোনও ছুঁৎমার্গ নেই। তিনিও তাঁর মতো করে বোঝাচ্ছেন, সমস্যাটা কোথায়।
চোট সারিয়ে ফিরে এসেছেন মহম্মদ সামি। তাঁর কাছে হাজির চোট সারিয়ে ফিরে আসা পাক বোলার শাহিন শাহ আফ্রিদি। বলছেন, তোমার মতোই হতে চেয়েছি। সামিও কী অবলীলায় শিখিয়ে দিচ্ছেন আফ্রিদিকে।
বিরাট কোহলি–রোহিত শর্মাদের দেখে একবার হ্যান্ডশেক করে যাচ্ছেন পাক জুনিয়র ক্রিকেটাররা। দু’চোখে বিস্ময়। কেউ সই চাইছেন। কেউ জার্সি। কেউ বলছেন, এবার আমাদের দেশে খেলতে আসুন।
এই তো সেদিন। মরুশহরে হচ্ছে এশিয়া কাপ। শচীনের এক ভক্ত সুধীর কুমার। ভারতের যেখানেই খেলা থাক, তিনি ঠিক গ্যালারিতে হাজির হয়ে যাবেন। অন্যদিকে, পাকিস্তানেরও এক এমনই পাগল সমর্থক আছেন— বসিরচাচা। যেখানেই পাকিস্তানের খেলা, বসিরচাচাও হাজির।
এবার সুধীর যেতে পারবেন কিনা, সংশয়ে ছিলেন। বসিরচাচাও নাছোড়, আসতেই হবে। তিনিই কিনা বিমানের টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিলেন সুধীরের জন্য। গ্যালারিতে একজনের গায়ে ভারতের পতাকা, একজনের গায়ে পাকিস্তানের।
ভারত–পাক ম্যাচের এমন কত টুকরো টুকরো সম্প্রীতির ছবি ছড়িয়ে আছে। একসময় বলা হত, কাশ্মীর সমস্যা কোনও সমস্যাই নয়। গাভাসকার আর ইমরান খানকে বসিয়ে দাও। ওরা দুজন ঠিক মিটিয়ে দেবেন। এই ভারতের কত রমনী যে ওয়াসিম আক্রামকে মনে মনে প্রেম নিবেদন করেছিলেন, তার ঠিকঠাক সমীক্ষা হলে সংখ্যাটা নিশ্চিতভাবেই লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
কিন্তু সেই ভারত খেলতে যায় না পাকিস্তানের মাটিতে। পাকিস্তান যে এ দেশে আসবে, তারও উপায় নেই। আমাদের দেশের আইপিএলে অচ্ছুৎ হয়ে থাকতে হয় পাক ক্রিকেটারদের। কোন ফ্র্যাঞ্চাইজির ঘাড়ে কটা মাথা তারা পাকিস্তানের খেলোয়াড়কে দলে নেবে!
আইসিসির ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রাম ঘোষিত হয়েছে। আগামী পাঁচ বছর এই দুই দেশের কোনও দ্বিপাক্ষিক সিরিজ রাখা হয়নি। তার মানে আগামী পাঁচ বছরও এক দেশ অন্য দেশে টেস্ট বা একদিনের সিরিজ খেলতে যাবে না। আগাম এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন বোর্ডকর্তারা? এখন তো আবার বোর্ডে সৌরভ নেই। জয় শাহ আরেক ধাপ ওপরে। তিনি আগ বাড়িয়ে ঘোষণা করে দিলেন, এশিয়া কাপেও পাকিস্তানের মাটিতে খেলতে যাবে না ভারত। তিনি ভারতীয় বোর্ডসচিব হওয়ার পাশাপাশি এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের সভাপতি। আগ বাড়িয়ে এখন থেকে এমন ঘোষণা করা খুব জরুরি ছিল?
দেশের ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বলছেন, সরকার অনুমতি না দিলে কিছু করার নেই। সরকার যে অনুমতি দেবে না, সেটা আগাম জয় শাহ ঘোষণা করে দিলেন! বাবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে সরকারি সিদ্ধান্ত ছেলেই ঘোষণা করে ফেললেন। কোনটা প্রকাশ্যে বলতে নেই, কোনটা আগাম বলতে নেই, এই ন্যূনতম বোধটুকুও যাঁর নেই, তিনি কিনা দেশের বোর্ডসচিব! তিনি কিনা বকলমে বোর্ড চালাবেন! ওই যে, বাবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলে যা হয়!
এই দুই দেশের শেষ দ্বিপাক্ষিক সিরিজ হয়েছে এক দশকেরও আগে। খেলার মাঝে এমন যুদ্ধ–যুদ্ধ আবহ কারা আনতে চাইছেন? ভারত–পাক রেশারেশি তো আগেও ছিল। তাই বলে গাভাসকার–কপিলদেবরা কি পাকিস্তানে যেতেন না? নাকি ইমরান–মিয়াদাদরা ভারতে আসতেন না?
সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে ভারত যেবার পাকিস্তানে গেল, সেবার পাক সফরে যাওয়ার আগে তাঁরা দেখা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে। বাজপেয়ী কী বলেছিলেন, আজও প্রবাদ হয়ে আছে। তিনি সৌরভ–শচীনদের বলেছিলেন, ‘দিল ভি জিতকে আনা।’ অর্থাৎ, হৃদয়ও জিতে এসো। একজন রাষ্ট্রনায়কের কাছে এমনটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু এখন পরিবেশটাই পাল্টে গেছে। জাতীয় চ্যানেলে সারাক্ষণ পাক বিরোধী জেহাদ। প্রতিদিন একটা করে যুদ্ধের আবহ তৈরি করো। যাই ঘটুক, এর সঙ্গে পাকিস্তানকে জুড়ে দাও। মনে মনে ঘৃণা ঢুকিয়ে দাও। রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় ছাড়া এমন প্রোপাগান্ডা চলতে পারে!
একা বিজেপিকে দায়ী করে লাভ নেই। ইউপিএ আমল থেকেই সিরিজ বন্ধ রাখার তোড়জোড়। আইপিএলে পাক ক্রিকেটারদের অচ্ছুৎ রাখার কাজটা প্রথম হয় ইউপিএ আমলেই। তাই তারাও আজকের এই পরিস্থিতির দায় অস্বীকার করতে পারে না। মুম্বইয়ে তাজ হোটেলে উগ্রপন্থী হামলার সঙ্গে ক্রিকেটকে জুড়ে দেওয়ার প্রবণতা তখনও দেখা গেছে। এই আমলে দিন দিন সেটা বাড়ছে। সরকারি উদ্যোগে ঘৃণার বিপুল বিস্তার। মাঝখান থেকে খেলাটাই বন্ধ হয়ে গেল। ওই দেশে সিরিজ খেলতে যাওয়া চলবে না। ওই দেশ থেকে এই দেশে সিরিজ খেলতে আসা যাবে না। ঘৃণার রাজনীতিকে ক্রিকেটের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
বোর্ডও অসহায়। তাকে সরকারের সুরে সুর মিলিয়েই কথা বলতে হবে। এক দশকের ওপর সিরিজ বন্ধ তো রাখলেন। এতে দুই দেশের সম্পর্কের কী উন্নতিটা হল? সেই আবহমান কাল ধরে শুনে আসছি, কাশ্মীর সমস্যা। এখনও সেই কি সেই সমস্যা কমেছে? বরং অনেক বেড়েছে। ভোট এলেই একটা করে সার্জিকাল স্ট্রাইক দেখাতে হবে। বীরত্বের ফানুস ওড়াতে হবে। নিজেদের সব অক্ষমতাকে আড়াল করতে দেশপ্রেমের হাওয়া তুলতে হবে। সামনের বছর ভোট। ধর্মের সুড়সুড়ির পাশাপাশি আরও একটা মোক্ষম তাস চাই। পাকিস্তান তো আছে। মাঝে মাঝে ভাবি, ভাগ্যিস একটা পাকিস্তান আছে। নইলে, এরা কী বলে ভোট চাইত? কী বলে হাওয়া গরম করত?
রাজনীতির ব্যাপার রাজনীতির লোকেরা বুঝুন। তার সঙ্গে খেলাকে না জুড়লেই নয়! নিজেরা সমস্যা মেটাতে পারছেন না। সেই ব্যর্থতার বোঝা খেলাধূলার ওপর কেন চাপাচ্ছেন? যে সম্প্রীতি আপনারা আনতে পারেননি, তা ক্রিকেটাররাই পারেন। ওঁদের খেলতে দিন। এই দমবন্ধ আবহে ওঁরা অন্তত তাজা অক্সিজেন আনতে পারবেন।