শান্তনু পাঁজা
আজ শোনাব একটু অন্য রকম গল্প। না চাইতেও অনেক কিছু পাওয়ার গল্প। সেটা এপ্রিলের ১১ তারিখ। চাকরিটা ছাড়ব ছাড়ব করে ছেড়েই দিয়েছিলাম ওই দিন। সেদিনই ঠিক করি ৩ মাস নোটিশ পিরিয়ড সার্ভ করার পর পাহাড়ে যাব। হিমালয়ের বর্ষা দেখব কিছুদিন, কোনও এক নির্জন গ্রামে বসে। ফেরার কোনও তাড়া থাকবে না। যেদিন ইচ্ছে হবে, সেদিন বাড়ি ফিরব।
আমার দুই বন্ধুকে ফোন করলাম। চাকরি সূত্রে আলাদা আলাদা জায়গায় থাকলেও একমাত্র ওরাই আছে আমার পাগলামির সাথে সাথ দেওয়ার জন্য। যেমনটা ভেবেছিলাম। ওদেরকে জানাতেই এক কথায় রাজি দুজনেই। দার্জিলিং মেলে জুলাই মাসের টিকিট কেটে নিলাম সঙ্গে সঙ্গে। ১০ তারিখ যাব, শুধু এটুকুই ঠিক ছিল। কোথায় যাব, কদিন থাকব, কিছুই ঠিক করে যাইনি। তাই ফেরার টিকিটটা ইচ্ছে করেই কাটলাম না।
সবাই বলেছিল, বর্ষাকালে পাহাড়ে যাচ্ছিস, তোদের ঘুরতে যাওয়া মাটি হবে। তাছাড়া ওই সময়টা বেশ বিপজ্জনক। জুলাই মাসে ভরা বর্ষাকাল। যখন তখন ধস নামতে পারে। রাস্তায় আটকেও পড়তে পারি। এইসব নানা উপদেশ, পরামর্শ আসছিল নানা দিক থেকে। কিন্তু আমি তো ভেবেই নিয়েছি, যা হয় দেখা যাবে। এরপর ৩ মাসের নোটিশ পিরিয়ড ধীরে ধীরে গড়াতে লাগল। ভেবেছিলাম, ৩মাসের মধ্যে কলকাতার কোনও না কোনও MNC থেকে তো চাকরির অফার পেয়েই যাব। কারণ এখন আইটি–তে চাহিদা ভালই। কিন্ত মানুষ ভাবে এক, আর হয় এক। ৩ মাসের মধ্যে কলকাতার কোনও কোম্পানি থেকেই ভাল অফার পেলাম না। যেটা পেলাম, সেটা বেঙ্গালুরুতে। যাই হোক, ভাবলাম ছুটি কাটিয়ে ওখানেই জয়েন করব। যদিও মনের মধ্যে শান্তি ছিল না, ভাবছিলাম এতদিনের কলকাতা ছাড়তে হবে, বন্ধুদেরকে আর আগের মতো পাব না, এইসব।
যাই হোক, আসল কথায় আসি। ১০ জুলাই সব কাজ সাঙ্গ করে করে ৩ বন্ধু দার্জিলিং মেলে উঠে পড়লাম। ট্রেন ছুটল নিজের মতোই। আমার মনে শান্তি নেই, রাতে একটুও ঘুম এল না। সকাল সাড়ে আটটায় নামলাম সেই প্ৰিয় স্টেশন নিউ জলপাইগুড়ি, যেখানে নামলেই মন ভাল হয়ে যায়। কিন্তু এবার পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। মনের মধ্যে দুশ্চিন্তাটা থেকেই গেছে। কিছুতেই যেন তাড়াতে পারছি না। যাই হোক, দর দাম করে একটা ছোট গাড়ি বুক করে চললাম রামধুরার পথে। রামধুরা হল কালিংপং জেলার ছোট্ট একটা জনপদ, যেখানকার নৈশব্দ নাকি কানে বাজে। আমার চেনা একজন জায়গাটার সন্ধান দিয়েছিলেন। কোন হোম স্টে–তে থাকা যায়, সেটাও বলে দিয়েছিলেন। আর সাত পাঁচ না ভেবে সেখানেই বুকিং করেছিলাম।
এনজেপি থেকে গাড়িতে উঠে শালুগাড়ার জঙ্গল পেরোতেই একটা ফোন পেলাম। ‘আমি কি শান্তনুর সঙ্গে কথা বলছি? একটা জব অপর্চুনিটির জন্য কল করছি। আপনি কি আজকে ৪টের সময় ইন্টারভিউ দিতে পারবেন?’ আমি সাত পাঁচ না ভেবে বললাম, ‘হাঁ পারব।’ ফোনটা এসেছিল একটা খুবই বড় কোম্পানি থেকে, তাও আবার কলকাতায়। রাস্তায় পাহাড়ি রেস্তোরাঁয় বসে অসম্ভব সুস্বাদু মোমো আর থুকপা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করলাম। পেটের খিদে তো মিটল। কিন্তু অন্য বারের মতো কেন জানিনা সফরটা কিছুইতেই বন্ধুদের সঙ্গে উপভোগ করতে পারছিলাম না। মনের মধ্যে শুধু ঘুরছে, ইন্টারভিউটা দিতে পারব তো! হ্যাঁ তো বলে দিলাম। কিন্তু প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দেবে না তো? শুনেছি, ওখানে নেটওয়ার্ক খুব একটা ভাল না। যত রামধুরার কাছাকাছি যাচ্ছিলাম ততবার বার ফোনটা দেখছিলাম, নেটওয়ার্ক আছে তো! আছে তো!
অবশেষে যখন হোম স্টের সামনে নামলাম, দেখলাম নেটওয়ার্ক ঠিকঠাক। মন বলছিল, এবার সত্যিই হয়তো কপালে অন্য কিছুই আছে। সত্যিই তাই হল। রুমের সামনে ব্যালকনিতে পা রাখতেই যা দেখলাম, সেটা এই ভরা বর্ষাকালে আমরা কেউ আশা করিনি। দিগন্ত জোড়া পাহাড়, মেঘে ভরা সবুজ উপত্যকা। এক মুহূর্তে সব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। আমি একটু একটু করে যেন হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছিলাম।
অবশেষে স্নান করে, কুনসং হোম স্টের দিদির হাতের অসম্ভব সুন্দর খাবার খেয়ে চাঙ্গা হলাম। তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মানে, বিকেল ৪টে। বন্ধুদেরকে বারান্দায় বসতে বলে, রুম করে বসলাম স্মার্ট ফোন থেকে ইন্টারভিউ দিতে। পুরো ইন্টারভিউটার সময় নেটওয়ার্ক ভালই ছিল, ইন্টারভিউটা হলও খুব ভাল। তারপর একটু মনের বোঝাটা নামতেই, ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় ছাড়তেই ঘুমের দেশে।
বড়োজোর ১ ঘন্টা ঘুমিয়েছি। অমনি ফোনটা বেজে উঠেছে। বিরক্ত হয়ে তুললাম। তারপর? ওই যে শুরুতেই বলেছিলাম, না চাইতেই অনেক কিছু পাওয়ার গল্প। ফোনের ওপার থেকে এক মহিলা বললেন, ‘শান্তনু, you have cleared the technical interview, HR will talk to you for the offer in 30 minutes’। মোদ্দা কথা, আমার একটা ইন্টারভিউ ক্লিয়ার হয়ে গেছে। আরেকটা দিতে হবে। তাড়াহুড়ো করে মুখে চোখে জল দিয়ে আবার বসলাম ইন্টারভিউ দিতে। এবার আর নেটওওয়ার্ক সহায় হল না। অনেকবার কল কেটে গেল, টেকনিক্যাল গোলযোগ হল। অবশেষে, ৩০ মিনিটের ইন্টারভিউ ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিটে শেষ হল, আর এবারেও আমি গোল দিলাম। এইচ আর সেকশন কনফার্ম করল যে, জব অফারটা আমি পাচ্ছি ২ দিনের মধ্যে। আমার তখন খুশি আর ধরে না। বন্ধুদের সঙ্গে সব খুশি ভাগ করে নিলাম। ওরাও আমার জন্য বেজায় খুশি। রাতে পাহাড়ি দেশি মুরগির ঝোল আর ভাত খেয়ে যেন তিন মাসের ঘুম সারলাম।
সকালে যখন সাড়ে চারটেয় ঘুম ভাঙল, তখন আরেক চমক। জানালা খুলতেই দেখলাম মেঘের আড়ালে সোনায় রাঙা কাঞ্চনজঙ্ঘা স্বমহিমায় বিরাজমান। আবারও সেই একই, না চাইতেও অনেক কিছু পাওয়া। আমি কোনওদিন আশা করিনি এই বর্ষার মরসুমে ওই মায়াময় রূপ দেখব। আগে বহুবার দেখেছি, অনেক কাছ থেকে দেখেছি, কিন্তু এবারের মতো কখনও না। তারপর আর কি বারান্দায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়েই কাটালাম তিন জনে। এরপর যতগুলো দিন ছিলাম, প্রতি দিন আমার প্রিয় পর্বত দেখা দিয়েছেন, কোনওদিন নিরাশ করেননি।
এত কিছু পাওয়ার পরেও একটা চিন্তা থেকেই গেল। ওই MNC আমাকে দুই দিনের মধ্যে অফার পাঠাবে বলেছিল। কিন্তু ৪দিন পরেও যখন কিছু এল না, তখন খুবই অস্থির লাগছিল। প্রকৃতি তার সমস্ত সৌন্দর্য উজাড় করে দিলেও আমি ভাবলাম শেষটা হয়তো ভাল হবে না। অবশেষে ফিরব ঠিক করে তৎকাল টিকিট কাটলাম ৫দিন পর। অনেকখানি ভাল লাগা, মন খারাপ আর দুশ্চিন্তা নিয়ে সমতলে নামলাম। নিউ জলপাইগুড়িতে রাত ৮টার দার্জিলিং মেলে উঠলাম। কিষানগঞ্জ পেরোতে না পেরোতেই ফোনে একটা নোটিফিকেশন এল। তাড়াহুড়ো করে মেলবক্স খুললাম। সত্যিই এই যাত্রায় পাহাড় দু’হাত ভরে সব দিল আমাকে। চিঠিতে লেখা ছিল “congratulations on your offer from…………”। যাওয়ার দিনেও উৎকণ্ঠায় ঘুম হয়নি, আজও আর ঘুম হবে বলে মনে হচ্ছে না।